ঈদ বাণিজ্যে অর্থপ্রবাহ

অর্থনীতি আবার পুরনো রূপে ফিরেছে। জমে উঠেছে ঈদবাজার। রেমিটেন্স, বিপণিবিতান, ই-কমার্সসহ সকল খাত হয়েছে চাঙ্গা। তথ্যানুযায়ী, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।

আর ক’টা দিন পরেই পালিত হবে ঈদের উৎসব। মুসলমানদের বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ। এই উৎসব উপলক্ষে ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছে ঈদ অর্থনীতি। আরবি মাস রমজানজুড়ে অর্থপ্রবাহ বেড়েছে কয়েকগুণ। করোনার কারণে গত দুই বছর (২০২০ ও ২০২১) থমকে ছিল উৎসবমুখর অর্থনৈতিক গতি প্রবাহ। ২০২২ সালে করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেও জনমনে আতঙ্ক থাকায় আর্থিক লেনদেন তেমন গতিময় হয়নি।

এবার অতিমারি নিয়ন্ত্রণে থাকার পাশাপাশি মানুষের মাঝেও এসেছে স্বস্তি। এজন্য অর্থনীতি আবার পুরনো রূপে ফিরেছে। জমে উঠেছে ঈদবাজার। রেমিটেন্স, বিপণিবিতান, ই-কমার্সসহ সকল খাত হয়েছে চাঙ্গা। তথ্যানুযায়ী, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। বৈশ্বিক মহামারিতে ব্যবসায়ীরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা এবার পুষিয়ে নেওয়ার পালা। ক্রেতারাও ছুটছেন এক মার্কেট থেকে অন্য মার্কেটে। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এ সময়ে নগদ অর্থপ্রবাহ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

ঈদ অর্থনীতিতে পোশাক বেচাকেনা : রমজানের শুরু থেকেই বিপণিবিতানে কেনাকাটার ধুম। ঈদে আবার নতুন ড্রেস হবে না এমনটা তো ভাবাই যায় না। বড় থেকে ছোট সবারই চাই নতুন ড্রেস। প্রাপ্তবয়স্করা একটি ড্রেসে সন্তুষ্ট হলেও টিনএজ ও শিশুদের কিন্তু একটি-দুটো ড্রেসে খুশি রাখা মহামুশকিল। আর তাদের বায়না মেটাতে মা-বাবারা ছুটে চলেছেন বিভিন্ন শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসে।

মার্কেটের ভিড় এড়াতে মধ্যবয়স্ক ইমন হাসান পনেরো রোজার দিন মেয়েকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়েন সকাল ১০টার দিকে। কিছু কেনাকাটা করেই ঘরে ফিরলেন। ইচ্ছা ছিল একদিনেই সবার জন্য নতুন পোশাক কিনে ফেলবেন। তা আর সম্ভব হলো না, মার্কেটে এত ভিড় অল্পতেই ক্লান্তি আসায় বাসায় ফিরলেন। আবার অন্যদিন যেতে হবে বাকি কেনাকাটা করতে। সারা বছর ধরে সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী একটা বাজেট করেন ঈদ কেন্দ্রিক। এই বাজেট সম্পূর্ণ করতে ছুটে চলছে মানুষ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশাখী উৎসবও। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের ঈদ ও পহেলা বৈশাখে অন্তত দুই লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।

চাঙ্গা হচ্ছে পরিবহন খাত : সারা বছর পরিবহন খাত একটা সরলরেখায় চললেও ঈদ উৎসবে দেখা যায় ভিন্নমাত্রা। বাসের টিকিট, ট্রেনের টিকিট, প্লেনের টিকিট, লঞ্চের কেবিন সব বুকিং হয়ে যায় ঈদের পনেরো দিন আগেই। দৌরাত্ম্য বাড়ে কালোবাজারিদেরও। শেষ পনেরো দিনে স্বাভাবিকভাবে টিকিট না পেলেও পাওয়া যায় এসব কালোবাজারির কাছে। দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করছে এসব টিকিট। অনেক ঝক্কিঝামেলার পরও সবাই ছুটে চলছেন গ্রামে।

তথ্যমতে, রাজধানীতে প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরটি ঈদের সময়ে প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। কেউ যায় দেশের বাড়িতে আবার কেউ ছুটি কাটাতে বিদেশে পাড়ি জমায়। উচ্চবিত্তরা দেশের বাইরে গেলেও মধ্যবিত্তরা ছুটে যান বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। এজন্য দেশের পর্যটন শিল্পও এ সময়ে হয় যথেষ্ট লাভবান।

রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বগতি : ঈদের সময়ে অর্থনীতিতে যোগ হয় প্রায় এক কোটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। দেশে পরিবারের আপন মানুষদের ঈদ উদযাপনে বাড়তি টাকা পাঠান তারা। সদ্য সমাপ্ত মার্চে মোট রেমিটেন্স এসেছে ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের বেশি, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ ডলার বা ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রবাসীরা জুলাই ও আগস্টে সবশেষ দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠিয়েছিলেন। এর পরের ছয় মাস রেমিটেন্স ২০০ কোটি ডলারের মধ্যে ছিল। গত মাসেই এ সীমা অতিক্রম করেছে। চলতি মাসে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। সাধারণত রোজা, ঈদ, বাংলা নববর্ষকে ঘিরে প্রবাসীরা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকেন। এবারও তেমনটিই হয়েছে।

বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠান প্রবাসী শ্রমিকরা, যা আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। আর মুসলমানদের প্রধান দুটো উৎসবে এই রেমিটেন্স বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

বাড়ছে ই-কমার্স ব্যবসা : শুরু থেকেই ই-কমার্স খাত ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। করোনাকালে হঠাৎ এই খাতের আস্ফালন দেখা দেয়। কেননা ঘরবন্দি মানুষের জীবনের প্রয়োজন মেটাতে ই-কমার্স ছিল একমাত্র ভরসার জায়গা। সে সময় লেনদেন বেড়ে যায় বহুগুণ। এই সুযোগে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী এই ব্যবসায় ঢুকে পড়লেও সরকার যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের আস্থা ফেরাতে আবার সক্ষম হয়েছে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত রমজানের শুরু থেকে অনলাইনে বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়ে। দেশে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন শপ প্রায় ১৫শ’ মতো। ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স বা এফ-কমার্স আছে ১০ হাজারেরও বেশি। সরকারি হিসাবে দেশের ই-কমার্স বাজারের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরের মধ্যে দেশের ই-কমার্স খাত ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর পৌঁছাবে বলেই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মানুষের কর্মব্যস্ততা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই অনেকেরই সময় হয় না মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করার। আবার অনেকে ভিড় ঠেলে শপিং করা পছন্দও করেন না। তারা প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফেলছেন ই-কমার্স প্লাটফর্ম থেকে। এজন্য দিন দিন বড় হচ্ছে ই-কমার্স বাজার।

বাড়তি টাকার বিনিয়োগ : ঈদের সময়ে অর্থনীতিতে যোগ হয় সরকারি সাড়ে ১২ লাখ এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-বোনাস।

অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়াতে এই টাকা ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। যাদের বছরে একটিও পোশাক কেনার সামর্থ্য থাকে না, তারাও এ সময়ে ছুটে চলেছেন মার্কেটে। নিজের জন্য ও প্রিয়জনের জন্য কেনাকাটা করতে। ফুটপাথ থেকে শুরু করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শপিংমল সকল বিপণিবিতানে লোকেলোকারণ্য। ঈদের সময়ে পোশাকের পাশাপাশি বাড়ে প্রসাধনী, মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের বিক্রি। প্রতিবছরই উৎসব ভাতার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগ হয়।

যাকাত ও ফিতরা : অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় জাকাত ও ফিতরা দানের সুফল অপরিসীম। পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করতে জাকাতের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। যা সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। বিত্তবানরা উৎসবকালীন যে অর্থ গরিবের মাঝে বিতরণ করে তা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রদান করলে অনেক পরিবার মুক্ত হতে পারত দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে। সামর্থ্যবানরা লাখ লাখ টাকা এবং জামা-কাপড় বিতরণ করছে।

এর মধ্যে সাময়িক আনন্দ থাকলেও, দীর্ঘস্থায়ীভাবে গরিব গরিবই থেকে যায়। অথচ প্রতিবছরই এই টাকার একটা অংশ দিয়ে অসহায় পরিবারকে রিকশা, ভ্যান অথবা গবাদিপশু কিনে দিলে, এর মাধ্যমে যেমন দারিদ্র্য নিরসন হবে, তেমনি বেকারত্বও হ্রাস পাবে। এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা একান্ত প্রয়োজন। বছর ঘুরে আসছে খুশির ঈদ। সবার মাঝেই ছড়িয়ে পরছে অনাবিল আনন্দ। নতুন জামা কেনা-কাটায় ব্যস্ত মানুষ। করোনাকালীন অসহায়ত্ব দূর করে নতুনভাবে মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্নে বিভোর। অর্থনীতিতে গতি প্রবাহ বেড়েছে বহুগুণ। এর মাধ্যমে সকল গ্লানি মুছে যাক, এটাই প্রত্যাশা।