সরকারি হাসপাতালেই ‘চেম্বার’ কার্যক্রম বৃহস্পতিবার থেকে

সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযোগ তারা হাসপাতালের চাইতে ব্যক্তিগত চেম্বারে বেশি সময় দেন। সরকারের নানামুখি পদক্ষেপেও এই অভিযোগ কমার কোনো নাম নেই। এতে করে নানামুখী ভোগান্তির শিকার হতে হয় রোগীদেরও। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চিকিৎসকদের নিজ প্রতিষ্ঠানে বৈকালিক চেম্বার চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। চলতি মাসের ১ তারিখ থেকেই চালু হওয়ায় কথা ছিল এই প্রাতিষ্ঠানিক চেম্বারের। কিন্তু নানামুখী চাপে তা বাস্তবায়ন না হলেও বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) থেকে পাইলটিং আকারে প্রাতিষ্ঠানিক চেম্বার চালু করা হচ্ছে।

এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট অফিস সময়ের বাইরের সময়ে সরকারি হাসপাতালেই চেম্বারের মাধ্যমে রোগী দেখবেন। পর্যায়ক্রমে এ সংক্রান্ত পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ৫০ উপজেলা, ২০ জেলা ও ৫ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুরু হবে এ কার্যক্রম।

তবে সোমবার এ সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ১০টি জেলা ও ২০টি উপজেলায় পাইলটিংভাবে এ চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হবে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ৫০০টি উপজেলায় শুরু হবে এ কার্যক্রম। এই প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ একজন অধ্যাপকের ফি ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা আর সর্বনি¤œ এমবিবিএস/বিডিএস ও সমমানের চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা।

এ বিষয়ে জাহিদ মালেক বলেন, চিকিৎসকদের ডিউটি সময়ের বাইরে বিভিন্ন ক্লিনিক বা ফার্মেসিতে যেভাবে চেম্বার খুলে রোগী দেখতে হতো, সরকারি এই বিশেষ সুবিধার জন্য নিজ নিজ কর্মস্থলেই সেই সুযোগ পাচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে চিকিৎসক নেতাসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত নিয়েছে সরকার। এই কাজটি শুরু করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের মতামত অনুসারে দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত জনকল্যাণকর এই মহানুভব কাজের শুরু করতে যাচ্ছি আমরা।

১ মার্চ না হলেও স্বাধীনতার মাসেই আমরা কার্যক্রম শুরু করছি। এই কাজটি শুরু হলে দেশের লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন ক্লিনিক, ফার্মেসিতে ডাক্তার দেখানোর ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবেন। পর্যায়ক্রমে আমাদের এ সংক্রান্ত পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু হবে। এটি একেবারে ছোট না। এর মাধ্যমে জনগণ আরেকটু ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবেন উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, হাসপাতালে গিয়ে তারা চিকিৎসক পাবেন। যারা ভর্তি আছেন, তারাও চিকিৎসা পাবেন। একসঙ্গে অনেক ডাক্তার পাওয়া যাবে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা থাকবে।

এটি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব কিছু নয় দাবি করে মন্ত্রী বলেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিস নতুন কনসেপ্ট নয়। শুরু করতে গাইডলাইন লাগবে, সেখানে সময়, অর্থ সব নিয়ে কাজ শুরু করব। কাজ করার মধ্যে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটি সমাধান করব।

স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এই প্রথমবারের মতো ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের বিষয়ে বলা হলেও রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) ২০১১ সাল থেকেই রোগীদের বৈকালিক সেবা দেয়া হচ্ছে। এখানে হাসপাতালের কর্মঘণ্টা শেষে ২৬টি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শুক্র ও শনিবার বাদে বাকি পাঁচদিন ২০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখেন। এই প্র্যাকটিস চলে বিকেল পর্যন্ত। এজন্য বেলা আড়াইটা থেকে বহির্বিভাগের বিশেষ সেবার টিকিট বিক্রি শুরু হয়।

এই অবকাঠামো বা সুবিধা অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই দাবি করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বিএসএমএমইউতে যখন এই সেবাটা চালু হয় তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সিনিয়র অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক সবারই প্রচুর আগ্রহ ছিল। রোগীরাও যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক্ষেত্রে সবার আগ্রহে ভাটা পরে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই কল্যাণমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের হার কমিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ছয় হাজার চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। এরপরও প্রতিবছর অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নেন।

তবে সব প্রতিকূলতা পেরিয়েই রোগীদের সরকারি হাসপাতালেই বেসরকারি চেম্বারের মতো চিকিৎসা দেয়া হবে বলে দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

তিনি বলেন, এর মাধ্যমে জনগণ আরেকটু ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবেন। হাসপাতালে গিয়ে তারা চিকিৎসক পাবেন। যারা ভর্তি আছেন, তারাও চিকিৎসা পাবেন। একসঙ্গে অনেক ডাক্তার পাওয়া যাবে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা থাকবে।
মন্ত্রী জানান, সরকারি ইনস্টিটিউটে প্র্যাকটিসের কথা বলা হয়েছে, তারা যাতে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে প্র্যাকটিস করতে পারেন। কারা, কতক্ষণ, কিভাবে প্র্যাকটিস করবেন, সেটি বাস্তবায়নে একটি টিম গঠন করেছি। তারা আমাদের অবহিত করবেন।

তবে বিষয়টি হুট করে একসঙ্গে বাস্তবায়ন না করে বরং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের তাগিদ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, এতবড় কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য অবকাঠামোর যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি প্রয়োজন পর্যাপ্ত জনবলের। শূন্য পদগুলোতে নিয়োগদান, চিকিৎসকদের বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত রোগী দেখার জন্য রোস্টার তৈরির পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত চেম্বার করারও সুযোগ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বৈকালিক চেম্বারকে মডেল হিসেবে ধরে প্রয়োজনে আরও এক বছর সময় নিয়ে এটি চালু করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।

তবে কষ্ট হলেও জনস্বার্থে চিকিৎসকরা এই কাজে এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে গঠিত কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক চেম্বার ধারণাটি আসলে অনেক পুরোনো। এটির বাস্তবায়নে নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান সরকার যেহেতু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটিকে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন তাহলে আমি মনে করি নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চিকিৎসক সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাগে এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে।