সম্ভাবনার পর্যটন

বিনিয়োগ হতে পারে ৩২শ’ কোটি ডলার

দেশের নৌ, বিমান, রেল এবং সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসায় পর্যটনখাত বিকাশের বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকার এই খাতের উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। পর্যটন মাস্টার প্ল্যানে দেশের আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে ৫৩টি আলাদা জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে দ্রুত ই-ভিসা চালু এবং বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মাধ্যমে ফ্লাইট বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সরকার আশা করছে, এইসব উদ্যোগের ফলে পর্যটন খাতে ৩২শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা যাবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে ৭২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।

পর্যটনে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, বাংলাদেশের পর্যটনকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য দেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ড নেম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মুজিব’স বাংলাদেশ’। এখন থেকে যারাই পর্যটনের প্রচার ও প্রসার ঘটাবেন এই ব্র্যান্ড নামেই করতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশকে চেনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। তাই বাংলাদেশের পর্যটনকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য এ দেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ড নেম নির্বাচন করা হয়েছে ‘মুজিব’স বাংলাদেশ’।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পর্যটন খাতে বিনিয়োগ সুযোগ নিয়ে প্রকাশিত এক উপস্থাপনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি সমাপ্ত বিজনেস সম্মেলনের একটি অধিবেশনে সচিব এই সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেন। তাঁর প্রবন্ধে দেশের উদীয়মান এই খাতে বিশাল বিনিয়োগের এ সম্ভাবনার বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশে দ্রুত ই-ভিসা চালু এবং ঢাকাকে ফ্লাইটের আঞ্চলিক ট্রানজিট হাব তৈরির মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়েছেন।

উপস্থাপনায় বলা হয়, দেশের মোট জিডিপিতে এখন পর্যটন খাতের অবদান মাত্র ৩ শতাংশ। যদিও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ১০ শতাংশের বেশি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর দুই দশকে পর্যটকদের বিদেশে যাওয়ার হার প্রায় ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। করোনার সময়ে মানুষ বিদেশ যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ পর্যটনে ব্যাপক সম্ভাবনা সামনে এসেছে। তাই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এ খাতের উন্নয়নে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করছে সরকার।

সারাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পর্যটনমুখী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেশের কমপক্ষে ৫০টি পর্যটন স্পট আকর্ষণীয় করতে অবকাঠামো, বিনিয়োগ ও ব্র্যান্ডিং পরিকল্পনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর জিডিপিতে এ খাতের অবদান নিয়ে যাওয়া হবে ১০ শতাংশে।

এ বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন বলেন, পর্যটন মাস্টার প্ল্যানে আমরা ১০টি বড় ধরনের প্রকল্প তৈরির কাজ করছি। এর মাধ্যমে দেশের পর্যটনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তাই তিনি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এ খাতে এগিয়ে আসার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। পর্যটনকে আরও সহজ করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে ই-ভিসা চালু হবে বলেও জানান তিনি।
সরকার ইতোমধ্যে পদ্মাসেতু, কক্সবাজার রেলওয়ে, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং স্থল এবং সমুদ্র বন্দরের আধুনিকায়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে।

এতে সারা দেশে সহজে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশে নতুন নতুন আন্তর্জাতিক হোটেলের শাখা খোলার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে বেশ কয়েকটি পর্যটন জোন নির্মাণ করছে সরকার। সেখানেও ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে হোটেল আগ্রাবাদের প্রধান নির্বাহী হাকিম আলী বলেন, দেশে অর্থনৈতিক জোনের আদলে পর্যটন জোন করছে সরকার। তাই অনেক আন্তর্জাতিক চেইন হোটেলগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। যা আগামীতে দেশের পর্যটনের চিত্র বদলে দেবে। তবে তিনি দেশে প্রমোদতরী পরিচালনার অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এসব ক্রুজশিপ চলে, তাই দেশেও এটার অনুমোদন দাবি করেন তিনি।

এদিকে পর্যটন খাতে ৮টি জোন তৈরির কাজ করছে সরকার। এর মধ্যে শালবন বিহারে একটি আধুনিক পর্যটন সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে সরকার ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে। আর বেসরকারি খাতের জন্য এক কোটি ডলার বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। একইভাবে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে একটি বিশেষ পর্যটন জোন তৈরি করা হবে। যেখানে সরকারি বিনিয়োগ হবে ১৫ লাখ ডলার। আর বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি ডলার।

পদ্মার চরে আরেকটি জোন তৈরি করা হবে। যেখানে সরকার প্রায় ৯৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার হবে সাড়ে ১৩ কোটি ডলারের। নাজিরেরটেকে আরেকটি ইকো-পার্কে সরকার ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে আর বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার হবে দেড় কোটি ডলারের।

এ ছাড়া কুয়াকাটায় সমুদ্র সৈকত ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। যেখানে ৪০ লাখ ডলার সরকারি বিনিয়োগ ছাড়াও লাগবে ২০ কোটি ডলারের বেসরকারি বিনিয়োগ। সুন্দরবনে প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে এমন একটি ইকো সাইট তৈরি করা হবে। যেখানে ১০ লাখ ডলার সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি ছয় কোটি ৭০ লাখ ডলার বেসরকারি বা বিদেশী বিনিয়োগ দরকার হবে। পদ্মা সেতু এবং শাহপরীর দ্বীপে এমন দুটি পর্যটন জোন গড়ে তোলা হবে। যেখানে যথাক্রমে ৩৮ কোটি এবং সাড়ে ২২ কোটি ডলারের বেসরকারি বা বিদেশী বিনিয়োগ দরকার হবে। এসব জোনে বিদেশী বা প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিনিয়োগ করার বিশেষ সুবিধা পাবেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অন্যতম একটি খাত হবে পর্যটন। আর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলটা বৈশ্বিক পর্যটনের বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের শীর্ষে রয়েছে। ভুটানে আমেরিকা থেকে পর্যটনে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে। তা ছাড়া যুক্তরাজ্য, জার্মান এবং চীন এ অঞ্চলের বেশকিছু দেশে বিনিয়োগ করেছে। তাই আমাদের দেশেও বিদেশী বিনিয়োগের সঠিক নীতি গ্রহণ করলে এসব দেশ থেকে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসার সুযোগ রয়েছে। আর বৈশ্বিক চাহিদা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসও পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে সরকার ঢাকাকে আন্তর্জাতিক ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত করতে চাইছে। এ বিষয়ে ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন- অ্যাটাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট আফসিয়া সালেহ বলেন, ঢাকায় আঞ্চলিক ট্রানজিট পয়েন্ট করতে চাইলে বিমান বন্দরের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরের চাংগি বিমানবন্দরের বিষয়টি উল্লেখ করেন। সেখানে পুরো বিমানবন্দরটি একটি পার্কের মতো করে সাজানো হয়েছে। তাই মানুষ সেখানে ট্রানজিট নিয়ে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে। আর বিশ্বমানের আবাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের মুম্বাই বিমান বন্দর এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে শুধু নেপালে বছরে ২৫ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করতে যায়। আর দুই দশকে এটা ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। তাই দেশে আন্তর্জাতিক মানের সুবিধা পেলে শুধু দেশীয় পর্যটক দিয়েই এ খাত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই এ খাতে বিনিয়োগের ওপর তারা ১০ বছরের জন্য কর ছাড় চাচ্ছেন।