চর থেকে চাকরি : বিধবা নাজমা ও অন্যদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

বাল্যবিয়ের পর দিন যতই গড়ায়, যৌতুকের চাপ ততই বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে চলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও। চরের অন্য নারীদের মতোই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে চলতে থাকে তার জীবন। তারপরও সংসার টেকেনি নাজমার। ফিরে আসেন বালাসী ঘাটে গরিব মায়ের ভঙ্গুর ভিটায়।

হতাশায় কয়েকবার আত্মহত্যার চিন্তা করেন। কেটে যায় কয়েক বছর। দিশে খুঁজে পায় না। এরই মধ্যে ২০ বছরের নাজমার পরিচয় হয় ‘এলা প্যাড’-এর লিমা আক্তারের সঙ্গে। গাইবান্ধার এলা প্যাড কেন্দ্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (সেইপ) সহযোগিতায় টানা ৪৫ দিনের নিবিড় সেলাই প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে যান। শিখে ফেলেন নানা ধরনের সুয়িং মেশিন পরিচালনার কলা-কৌশল। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন তিনি।

নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলেন। এলা প্যাডের সহায়তায় বেক্সিমকো গ্রুপের এসেস ফ্যাশন লিমিটেডে সুয়িং মেশিন জুনিয়র অপারেটর হিসেবে যোগ দেন। তিন মাস আগের হতাশ নাজমা এখন স্বচ্ছল, স্বাধীন। সমাদৃত তার পরিবারের কাছে। শহরের ছন্দময় সময়ে তার কাছে এখন চরের সেই সংগ্রামী জীবন শুধুই অতীত। স্বপ্ন তার কবে অপারেটর থেকে সুপারভাইজার হবে। এসেস ফ্যাশন লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক আমির ফয়সাল নাজমার দক্ষতার প্রশংসা করে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বলেন। নাজমার সঙ্গে একই কারখানায় যোগ দেয় বালাসী ঘাটের জেলেপল্লির অঞ্জলি রানী আর রুবিনা বেগম।

এদের মতো চর এলাকার ৩০ জন সুবিধাবঞ্চিত নারীরা এক সঙ্গে বিজিএমইর সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নেন। অনেকেই বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছে। কেউ আবার স্থানীয়ভাবে সেলাইয়ের কাজ করছে। গার্মেন্টসের ফেলে দেওয়া টুকরা পুনঃব্যবহার করে তৈরি করছে স্যানিটারি প্যাড আর পিরিয়ড প্যান্টি।

সম্প্রতি এলা প্যাডের কার্যক্রম সরেজমিনে দেখতে গাইবান্ধা আসেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও সেইপ প্রকল্পের সহকারী উপকার্যনির্বাহী পরিচালক আনারুল কবির। এক এক করে কথা বলেন প্রায় ৩০ জন নারী প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে। জানার চেষ্টা করেন চরের নারীদের জীবন সংগ্রাম। নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি ও ক্ষমতায়নে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।

নাজমা জানান, ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন। এক বেলা খাবার জুটলে অন্য বেলায় উপোস থাকতে হতো। তার ওপর অসুস্থ বাবার কাজ নেই। চার বোনকে নিয়ে তার মায়ের অনেক কষ্ট। ছেলে নেই। মেয়েদের কারণে নানা কটু কথা শুনতে হয়। পৈতৃক ভিটা ব্রহ্মপুত্র নদীতে বিলীন হয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে অন্য চরে। ভেঙেছে সেটিও। ১৩ বছর বয়সে, ২০১৭ সালে এলাকায় এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন গায়ের রং ফর্সা না হওয়ায় ছিলেন অসন্তুষ্ট। নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্যও করতেন। প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য চাপ দিত। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসতে বাধ্য করার চেষ্টা চলত। কিন্তু এই টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই তাদের পরিবারের। ফলে সেই সংসার আর বেশি দিন টেকেনি।

নাজমার চলে আসা তার পরিবার ও প্রতিবেশীরা খুব একটা ভালোভাবে নিতে পারেননি। নানারকম বাজে মন্তব্য শুনতে হতো প্রতিনিয়ত। তবে নাজমা ভাবলেন, কারও বোঝা হবেন না। নিজেকে বাঁচতেই হবে। তার অসুস্থ মা-বাবাকেও দেখতে হবে। এত কষ্টের মধ্যেও এলা প্যাডের প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেলেন। চর এলাকার নারীদের কাছে এলা প্যাড বিক্রি করতে থাকেন। কিছু কিছু সঞ্চয় করেন। এক দিন সিদ্বান্ত নেন ঢাকা গিয়ে বড় ফ্যাক্টরিতে চাকরি করবেন।

নাজমা এখন কাজ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে; পাশাপাশি এলা প্যাডের কার্যক্রম চালায় তার সহকর্মীদের মধ্যে। এসেস ফ্যাশনের আমির ফয়সালের উৎসাহে পোশাক কারখানার নারী শ্ৰমিকদের মাসিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সচেতনতা তৈরি করেন নাজমা।

নাজমার ঘুরে দাঁড়ানো এখন চরের অন্য নারীদের কাছে অনুকরণীয়।