উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেট্রোরেলের যুগে এখন সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধন করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাক্সিক্ষত এই মেট্রোরেল দ্রুতগতিতে ছুটবে রাজধানীর বুকচিরে। নগরবাসী স্বল্প সময়ে পৌঁছবেন ঢাকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত জনবহুল মহানগরী ঢাকা ও পাশর্^বর্তী জেলার যানজট নিরসনে দ্রুতগামী, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সময় সাশ্রয়ী, বিদুৎচালিত, পরিবেশবান্ধব ও দূরনিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন সরকারের একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি অনন্য মাইলফলক। মেট্রোরেলের এলিট ক্লাবে সুস্বাগতম। তীব্র যানজটের নাকাল হওয়া রাজধানীবাসীর জন্য আশীর্বাদ এই মেট্রোরেল। মেট্রোরেল এখন জাতীয় সম্পদ ও গৌরবের মূর্তপ্রতীক। মেট্রোরেল বাংলাদেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা, প্রেরণার উৎস এর সুফল শুধু রাজধানীবাসী নয়, পুরো দেশ উপভোগ করবে। অর্থনীতিতে রাখবে বড় ধরনের ভূমিকা। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ার ফলে মানসিক ও শারীরিক স্বস্তিও মিলবে।
ঢাকায় প্রতিনিয়ত যানবাহন বৃদ্ধির কারণে যাতায়াতে ভোগান্তি বাড়ছে নগরবাসীর। স্বল্প দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সীমাহীন দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে। যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি।
যানজটের কারণে ঢাকা মহানগরীতে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে কর্মজীবীদের, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরে যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতির মতো ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে চলে এসেছে। ১২ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের এ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।
ডিসেম্বর মাসকেই বেছে নেওয়া হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল উদ্বোধনের জন্য। পদ্মা সেতুর পর যোগাযোগ খাতের আরেক স্বাপ্নিক প্রকল্প মেট্রোরেল লাইন-৬ যাত্রী চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চালু হয়েছে রাজধানীবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল। এই স্বপ্নের প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে। মানুষের ভোগান্তি দূর করতে, ঢাকাকে যানজটমুক্ত করার জন্য বর্তমান সরকার ২০১২ সালে ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলের পরিকল্পনা করে। পরীক্ষামূলক এই চলাচলের জন্য মোট ১৯টি ধাপ শেষ করতে হয়েছে। সেই ধাপগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কি-না সেটি নিশ্চিত হওয়াই এই চলাচলের উদ্দেশ্য।
ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে ট্রেন। তাই সময় আর গতির মেলবন্ধন ঠিক করার পরীক্ষাও চলছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের ইন্টিগ্রেশন টেস্ট। প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের পথে চলবে ১০ সেট ট্রেন। প্রতি সেট ট্রেনে থাকছে ছয় বগি। একেক বগিতে ৫৪ জনের বসার ব্যবস্থা। দাঁড়িয়ে ভ্রমণের জন্য আছে পর্যাপ্ত জায়গা। একেকটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮৮ জন যাত্রী চড়তে পারবেন। সেই হিসাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ঘণ্টায় যাতায়াত করবেন কমপক্ষে ৩০ হাজার যাত্রী।
স্টেশনগুলোতে থাকছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। প্রতি স্টেশনের দ্বিতীয় তলাটি যাত্রীরা ফুটওভারব্রিজ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন। থাকবে নানা পণ্যের দোকান। তবে, তৃতীয় তলার প্ল্যাটফর্মে উঠতে লাগবে টিকিট। গন্তব্যে যেতে যাত্রীরা সব স্টেশনেই টিকিট কাটতে পারবেন। থাকছে মেট্রোপাসের সুবিধাও। শুরুতে ১০ মিনিট পরপর মিলবে ট্রেন। পরে যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পর পর ট্রেন এসে দাঁড়াবে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য। পুরো পথটি চালু হলে ঢাকার যোগাযোগে যেমন গতি আসবে তেমনি জিডিপিতে যুক্ত হবে ১ শতাংশ।
মেট্রোরেল সুবিধাজনক পরিবহন পরিষেবা প্রদান করবে যারা ব্যয়বহুল গণপরিবহন ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে কুলিয়ে উঠতে পারে না এবং সাশ্রয়ী পরিবহনের অভাবে ক্রমাগত ভোগান্তিতে পড়ে। যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ এর বেশি।
২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। এ ছাড়া ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশ এর সমান। তা ছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
মেট্রোরেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। উন্নত দেশগুলোয় মেট্রোরেল এবং অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন মাধ্যমগুলোকে একত্রিত করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ শুধু একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে মেট্রোরেলে ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সবধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে।
এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ঢাকাবাসীর যাতায়াতের একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হবে মেট্রোরেল। কারণ এটি প্রচুর যাত্রী বহন ক্ষমতাসহ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন সুবিধা প্রদান করবে, এটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করবে এবং প্রতি ৪ মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন যাতায়াত করবে।
মেট্রোরেল পরিপূর্ণরূপে চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে। মানুষ বাসা ভাড়া অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় আসতে পারে। তা ছাড়া, অনেক বাণিজ্যিক উন্নয়ন ঘটবে এবং রুটের চারপাশে সুবিধাগুলোর ভাড়া এবং মূল্য বাড়বে। দ্বিতীয়ত, আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য পুনর্নির্মাণ করা হবে। ফলস্বরূপ, ওইসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন কম ভাড়ার জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ কেন্দ্রীয় শহর থেকে বিকেন্দ্রীভূত হবে।
মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণ অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় অনেক বেশি তীব্র। যেহেতু মেট্রোরেল ‘বিদ্যুৎচালিত’ এবং প্রতি ঘণ্টায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, তাই ঢাকায় বাস ও অন্যান্য পরিবহনের মাধ্যমে যাতায়াতের প্রবণতা কমে যাবে। এতে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কমবে, যা পরিবেশের জন্য উপকারী হবে।
রাজধানীর ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর ডিওএইচএস ও মিরপুর সাড়ে এগারো নম্বর এলাকাকে সংযোগকারী কালশী উড়াল সেতু উদ্বোধন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়াল সেতু উদ্বোধন করেন। এটি মিরপুরের সঙ্গে বনানী, উত্তরা এবং রাজধানীর পূর্বাংশের যোগাযোগ আরও সহজ করবে। জানা গেছে, ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে উড়াল সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি।
মোট ১ হাজার ১২ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় ইসিবি চত্বর থেকে কালশী পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত হয়েছে। কালশী মোড়ে হয়েছে ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সেতু। চার লেনের এই উড়াল সেতুর র্যাম্প তিনটি। ইসিবি চত্বর থেকে কালশী ও মিরপুর ডিওএইচএসমুখী মূল উড়াল সেতুটি চার লেনের। কালশী মোড় থেকে কালশী সড়কের দিকে নেমেছে দুই লেনের একটি র্যাম্প। মিরপুর ডিওএইচএস প্রান্ত এবং ইসিবি চত্বরের দিকের প্রান্ত থেকে উড়াল সেতুতে ওঠা যাবে। কালশী রোড প্রান্ত দিয়ে নামার সুযোগ রয়েছে।
বিমানবন্দর সড়ক থেকে মিরপুর এলাকায় ঢোকার একটা প্রবেশপথ কালশী সড়ক। তবে ওই এলাকায় সব সময় যানজট লেগে থাকত। যানজটের ভয়ে ১০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে মিরপুর যেতে হতো। উড়াল সেতু হওয়ায় আর তা করতে হবে না। উড়াল সেতু এলাকায় দুটি পদচারী সেতু (ফুটওভার ব্রিজ) করা হয়েছে, তাতে চলন্তসিঁড়ি থাকবে। এ ছাড়া বাইসাইকেলের জন্য আলাদা লেন রয়েছে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী উদ্যোগ মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এমন উন্নতি করেছে, যাতে বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে ৬/৭ ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীতে এসে পৌঁছানো যায়। আরও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা করার জন্য কাজ চলমান আছে, চলমান থাকবে।
কাজেই, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল সেই স্বপ্নের প্রকল্প, যে প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে সে সময় বেশি দূরেও নয়। সেই সোনালি ভবিষ্যতের উন্নত মহানগর ঢাকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ মেট্রোরেল আজ বাস্তব। অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়