একজন দূরদর্শী নেতা তার দেশের জন্য অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন, সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নও করেন। বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ২৪ বছর লড়াই, সংগ্রাম, জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতিকে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, দল ক্ষমতায় এলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করবেন। তখন বিষয়টিকে অনেকে হাস্যকর মনে করেছিল। কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শুধু জনগণকে স্বপ্ন দেখায় না, সেটাকে বাস্তবায়নও করে-যার প্রমাণ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ, এটি এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি জেলার বেতবুনিয়ায় প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সেদিন থেকে জাতির পিতার হাত ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের গোড়াপত্তন শুরু হয়েছিল।
জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন আগামীর বাংলাদেশ হবে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থাৎ স্মার্ট বাংলাদেশ। তিনি বলেছেন, চারটি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ২০৪১ সালেই বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হবে। ১. স্মার্ট সিটিজেন, প্রতিটি নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, ২. স্মার্ট ইকোনমি, অর্থনীতির সব লেনদেন হবে প্রযুক্তিনির্ভর, ৩.স্মার্ট গভর্নমেন্ট, সরকারি সুযোগ-সুবিধা হবে প্রযুক্তিনির্ভর, ৪. স্মার্ট সোসাইটি, পুরো সমাজই হবে প্রযুক্তিবান্ধব। এভাবেই তিনি ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। সমালোচক সুশীলরা এটাকে উচ্চাভিলাষী বলে মনে করছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তখনও এরা অসম্ভব বলে কটাক্ষ করেছিল। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকন্যা, তিনি যেটা লক্ষ্য নির্ধারণ করেন, সেটা যত কঠিনই হোক বাস্তবায়ন করে দেখান।
বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। এটি সমালোচনাকারীরাও স্বীকার করতে বাধ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার সুযোগ্য পুত্র, তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সুনির্দিষ্ট চারটি স্তম্ভ- সবার জন্য কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নমেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশনকে ভিত্তি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সরকারের সব প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পড়াশোনা, চাকরির আবেদন, মোবাইল মানি ট্রান্সফার, পাসপোর্ট আবেদন, ভিসা প্রসেসিং, বিমান, রেল ও বাসের ই-টিকেট, ই-টেন্ডারিং, টিন সার্টিফিকেট, জিডি, জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন সবই অনলাইনে করা যাচ্ছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত প্রযুক্তির ছোঁয়া পৌঁছে গেছে। ইউনিয়ন পর্যন্ত নেটওয়ার্ক মনিটরিং সিস্টেমে সংযুক্ত করা হয়েছে। ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সরকারের তথ্য ও নির্দেশনা জনগণের কাছে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে পণ্য কেনাবেচা, ই-বুক প্ল্যাটফর্ম, টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবা, বাড়িতে বসে আয়করের রিটার্ন দাখিল, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ দ্রুত ও সহজতর হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল অনলাইনেই দেওয়া যাচ্ছে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে সরকারি সেবা ‘মোবাইল হেল্প’ লাইন চালু হয়েছে।
সরকারি তথ্য ও সেবা-৩৩৩, জরুরি সেবা (পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স)-৯৯৯, জাতীয় পরিচয় তথ্য-১০৫, দুদক-১০৬, দুর্যোগ বার্তা-১০৯০, শিশু সহায়তা-১০৯৮, কৃষক বন্ধু ফোন সেবা-৩৩৩১ মোবাইল হেল্প লাইনের মাধ্যমে জনগণ ঘরে বসেই অনেক জরুরি সেবা পেয়ে যাচ্ছে।
সরকারের মেগা প্রকল্পে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, সেতুতে রেলও চালু হওয়ার পথে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে এক সময় পদ্মা সেতু নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন বলেই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। এক সময় ঢাকা শহরে মেট্রোরেল চলবে সেটা অলীক স্বপ্ন ছিল, মেট্রোরেল চালু হয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মিত হয়েছে, যা চালুর অপেক্ষায় আছে। পাবনার ঈশ^রদীতে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে। ফলে ২০২৪ সালেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ ছাড়াও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল ও গ্যাস লাইন প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ প্রায় সব মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে সব প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হবে।
মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ স্যাটেলাইট এলিট ক্লাবের সদস্য। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রেরণের কাজ চলছে। বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেশ কিছু হাইটেক পার্ক তৈরি করা হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মোবাইল হ্যান্ডসেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ প্রতিটি প্রযুক্তিগত পণ্যে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা দেখা যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তির রফতানি আয় পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন কর্মসূচি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন।
আধুনিক উন্নত-সমৃদ্ধ প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ৪টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছেন। ১. ২০২১ সালের মধ্যে রূপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে, ২. ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ৩. ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ অর্থাৎ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা ৪. ২১০০ সালের মধ্যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রথম ধাপ হিসেবে ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ অর্থাৎ ভিশন-৪১ বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫), ৯ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২৬-২০৩০), ১০ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০৩১-২০৩৫) এবং একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০৩৬-২০৪১)। ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, তখন মাথাপিছু আয় হবে প্রায় ৬ হাজার ডলার, যা ২০৪১ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১২৫০০ ডলার। তখন জাতীয় অর্থনীতিতে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের অবদান হবে শতকরা ২০ শতাংশ।
শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি, দারিদ্র্য বিমোচন, শতভাগ বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাতের অভূত উন্নয়নের কারণে বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে বাংলাদেশ অধিষ্ঠিত। ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং উদ্ভাবনী। অর্থাৎ সব কাজই হবে স্মার্ট। গ্রাম আর শহরের কোনো ভিন্নতা থাকবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের যে ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সে পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী নেতা, তিনি স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্নকে জনগণের মধ্যে জাগরিত করেন এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন। শেখ হাসিনার দর্শনই হলো স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন করা।
লেখক : তাপস হালদার,
সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ