কৃষি খাতকে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই

কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ক জন্ম থেকেই একে অপরের পরিপূরক। আর স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। প্রতি বছর দেশে .৪৩ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়লেও কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। এ অবস্থায় কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য গতিশীল কৃষির যান্ত্রিকীকরণ প্রয়োজন। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও বাংলার সব কৃষক এখনও তার ফল ভোগ করতে পারেনি। দেশের কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের বিকাশ মূলত ধান চাষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তবে ধানকেন্দ্রিক যান্ত্রিকতা থেকে বের হয়ে আমাদের কৃষি খাতকেই যান্ত্রিকতার আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

দেশের ৯৫ শতাংশ জমি এখন পাওয়ারটিলার, ট্রাক্টর ও কম্বাইন হার্ভেস্টার দিয়ে আবাদ করা যাচ্ছে। ৮৫ শতাংশের বেশি সেচ এখন যন্ত্রের মাধ্যমে হচ্ছে। কিন্তু ধান লাগানোর ক্ষেত্রে ১-২ শতাংশ হয়েছে।

এ ছাড়াও ধান ছাড়া অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রে এখনও সেভাবে যন্ত্রের ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পিছিয়ে থাকা মৎস্য খাত ও প্রাণিসম্পদ খাতেও নানা রকম যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এসেছে তা-ও পর্যাপ্ত নয়। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে এই যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া। কেননা এখন পর্যন্ত কৃষির যেসব ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে, সেটিই গ্রামীণ অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। তাই গ্রামীণ অর্থনীতির গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ জরুরি আর গ্রামীণ কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রধান হাতিয়ার করতে হবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। তাই কেবল যান্ত্রিকীকরণ করেই অনেক বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষতিও কমানো সম্ভব হবে। কৃষিযন্ত্রের কথা শুনলে আমাদের দেশের কৃষি শ্রমিকরা আঁতকে ওঠে। তারা ভাবে যন্ত্র এসে তাদের কাজটুকু কেড়ে নেবে। এখন আর সেই দিন নেই। এখন একটি কৃষিযন্ত্র গ্রামের একজন তরুণের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আধুনিক চাষ পদ্ধতির সঙ্গে টিকে থাকতে মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারণা দিয়ে সম্ভব নয়। এটি সবাই বুঝে গেছে। সময়ের বিবর্তনে কাজেরও বহু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

তা ছাড়াও এখন কৃষি শ্রমিকেরও তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণেও কৃষি হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল। আর এর সমাধান আসতে পারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই।

দেশে বাণিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদনে যান্ত্রিকীকরণ প্রচলন হলে কম খরচে উৎপাদনের পাশাপাশি মানও নিশ্চিত করা যাবে। ভুট্টায় যান্ত্রিকীকরণ করা হলে ভুট্টা চাষিরা ভুট্টা উৎপাদনে আরও আগ্রহী হবে। এতে করে একদিকে দেশে যেমন আটার চাহিদা মিটবে, অন্যদিকে হাঁস-মুরগির খাবারের জোগান বাড়বে। তাছাড়া মাছের প্রক্রিয়াকরণেও যান্ত্রিকীকরণের সুযোগ আছে। গবাদিপশুতেও যান্ত্রিকীকরণের প্রাথমিক ধাপও আছে। বিশেষ করে মিল্কিংয়ের জন্য যান্ত্রিকীকরণ অনেক দরকার। দুধ পরিবহনেও যান্ত্রিকীকরণের সুযোগ রয়েছে। পোস্ট-হারভেস্ট লস কমিয়ে আনার জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিভিন্ন শস্যের জন্য যে অপচয় হচ্ছে সেটি রোধ করার জন্য হলেও কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করতে হবে।

বাংলাদেশে প্রায় ৬২ শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন সেক্টরে, যার মধ্যে শস্য সেক্টরেই প্রায় ৫৫ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি সেক্টরের যেমন চাপ বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্যশস্য উৎপাদন, সেই সঙ্গে বাড়ছে এই সেক্টরের গুরুত্ব। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকার সত্ত্বেও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করা হলে দেশের খাদ্য উৎপাদন ২৫ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি অর্জন করা সম্ভব হবে।

গত অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৯৫ মিলিয়ন মেট্রিকটন। তবে শস্য সংগ্রহের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শুধু কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতি বছর মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের ৭-১০ ভাগ অপচয় হয়। কৃষিকাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিতকরণ করা হলে বছরে আরও ৭০ মিলিয়ন খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হবে।

তাই সমন্বিত আধুনিকায়ন ও পরিকল্পিত যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে প্রবীণ কৃষকদের কাজ সহজ করে দিতে হবে, তাদের উৎসাহী করতে হবে। অন্যদিকে যান্ত্রিক কৃষির দিকে তরুণদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি অর্গানিক কৃষি ও গ্যাপ সার্টিফায়েড কৃষির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। তাই বাণিজ্যিক কৃষির বিকল্প নেই। যেখানে ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ড প্রতি হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন করেছে গড়ে সাত টনের বেশি, আমরা সেখানে উৎপাদন করছি ৪ থেকে ৫ টন। মাছ-মাংস, সবজি ও বিভিন্ন ফসল এসব দেশ একই জমিতে আমাদের চেয়ে বেশি হারে উৎপাদন করছে। আর সফলতা পেতে আমাদেরকেও তাদের অনুসরণ করা উচিত। তাই এসব প্রকল্প হতে খামার যান্ত্রিকীকরণ ফসল ফলানোত্তর কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মৎস্য প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ করতে হবে।
কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ, কৃষি শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

লেখক: আবির সুজন,
শিক্ষার্থী, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়