আগে যারা কথা শোনাত, তারাই এখন প্রশংসা করে

অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধি ও অন্যান্য স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কারিশমা’। সদস্য ৩৯ জন। সবাই মহাখালীর পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্টের শিক্ষার্থী। সেই ট্রাস্টের উদ্যোগেই ২০১৫ সালে ‘আলোর মুক্তি’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল তারা। সেখানে দারুণ সাড়া পেলে পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে কারিশমা। নাচ, গান, অভিনয়ের মতো বিষয়গুলো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিকাশে সহায়ক। অটিস্টিক ও স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাটক, নাচ, গান, চিত্রাঙ্কন, উপস্থাপনাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, যেমন—গিটার, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি চালনা শেখাচ্ছে কারিশমা। প্রশিক্ষক মোট ১১ জন। সংগঠনটির ইনচার্জ আমীর হোসেন (সিনিয়র স্পেশাল এডুকেটর)। নাটক, নাচ, গান ও কোরিওগ্রাফির প্রশিক্ষক এবং স্টেজ ডিজাইনের দায়িত্বে আছে নুরুল আমিন এবং তাঁর আর্ট ও ক্রাফট বাহিনী। তাদের মাথায় ছায়া হয়ে আছেন পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাজিদা রহমান ড্যানি।

অর্জনের পাল্লাও ভারী
এখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তালিকাভুক্ত দল কারিশমা। এ পর্যন্ত ছয়বার জাতীয় নাট্যশালায় নাটক, ১৫ বার টিভি, দুইবার রেডিও, ২৮ বার মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছে। তারা বিদেশের মঞ্চেও একাধিকবার পারফরম করেছে। হংকংয়ে অনুষ্ঠিত ‘অটিস্টিক ট্যালেন্ট গালা ২০১৭ ও ২০১৯’-এ অংশ নিয়ে ১৩টি দেশের মধ্যে ‘বেস্ট ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট অ্যাওয়ার্ড’ ও ‘এক্সিলেন্স পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত চতুর্থ শিশু-কিশোর নাট্য উৎসবে অংশ নিয়ে জিতেছে মঞ্চকুঁড়ি পুরস্কার।

আমরা সবাই রাজা
কারিশমার শিল্পীরা সবাই রাজা তাদের রাজত্বে। তবে বারবার ঘষেমেজে এই রাজাদের ‘মঞ্চের সিংহাসনে’ বসাতে হয়েছে। তাদের ‘রাজা’ হওয়ার পেছনে আছে কঠোর পরিশ্রম, মেধা আর অধ্যবসায়!

শিল্পীদের অনেকেই ঠিকমতো বলতে পারত না। অনেকে অতিচঞ্চল। ঠিক কোন বিষয় নিয়ে আলাপ করা হচ্ছে, সেটিও ধরতে পারত না অনেকে। আবার কেউ ‘এক্সিকিউশন ডিলে’ মানে নির্দিষ্ট কাজটি বুঝেছে, কিন্তু কিভাবে সেটি সম্পন্ন করবে জানে না। কারো সমন্বয় এবং সিংক্রোনাইজেশন বা ছন্দোময়তায় সমস্যা আছে। অন্যদের সঙ্গে তাল মেলাতে অসুবিধা হতো। স্টেজ ফোবিয়া তো ছিলই; কেউ কেউ আবার স্টেজে গিয়ে দর্শকদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠত। এমন হাজারো সমস্যা মোকাবেলা করে কাজ করতে হয়েছে শিক্ষকদের।

কিছু হার না মানা মা আছেন, যাঁদের বিশ্বাস, শত প্রতিবন্ধকতার পরও সন্তান পারবে। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই সাহস করেছিলেন সাজিদা রহমান ড্যানি। যার যেটুকু প্রতিভা আছে, সেটি তুলে আনবেন—এই ছিল প্রত্যয়। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন শিক্ষকরা। ওদের প্রতিবন্ধিতার ধরন জানতে হয়েছে। স্নায়বিক প্রতিবন্ধকতাসহ নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। নাটকের একেকটি চরিত্রের সঙ্গে কিভাবে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, কিভাবে তাদের ঘাটতিগুলো পূরণ করে চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে উপস্থাপন করা যাবে, তা নিয়ে চলেছে নিরন্তর গবেষণা।

কারিশমার সাজু ও রূপাই
‘আলোর মুক্তি’, ‘ইচ্ছে ঘুড়ি’, ‘গোঁফ চুরি’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘মানচিত্রের জন্য’সহ বেশ কিছু নাটক মঞ্চায়ন করেছে কারিশমা। তাদের এখন পর্যন্ত দর্শকনন্দিত প্রযোজনা ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। নাটকটির প্রধান চরিত্র রূপাই। ফুটিয়ে তুলেছে সাফওয়ানুল আমিন। তার লার্নিং ডিস-এবিলিটি আছে। পড়তে বা লিখতে একদমই পারে না। তাই শিক্ষক তাকে দিনের পর দিন সংলাপ মুখস্থ করিয়েছেন। কিন্তু মঞ্চে তার অঙ্গভঙ্গি, চরিত্রকে ধারণ করার দক্ষতা, আবেগের প্রকাশ অসাধারণ। সাফওয়ান বলল, ‘প্রথমে নার্ভাস লাগত। স্টেজে উঠতেও লাজ লাজ লাগত। এখন এনজয় পাই।’ তার মা মোহসেনা ইয়াসমিন বললেন, ‘ভাবতাম সাফওয়ান কিছুই পারে না। খুব মন খারাপ হতো। এখন তার অভিনয় দেখে চোখ জুড়ায়। শান্তি লাগে এই ভেবে যে আমার ছেলে অন্তত কিছু একটা পারে।’

সাজুর চরিত্রায়ণ করেছে ইসাবা হাফিজ সুস্মি। সে যুক্তবর্ণ ও বড় শব্দ ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারত না। নাটকে গ্রামের মানুষের সাধারণ কিছু সংলাপ আছে। এই সাধারণ সংলাপই অসাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। শিক্ষকরা বিভিন্ন উদ্ভাবনী সমাধানের মাধ্যমে এর সমাধান করেছেন। এখন সুস্মির সঙ্গে আলাপে বুঝতেই পারবেন না একসময় সে এই সমস্যাগুলো নিয়ে ভুগেছে। দারুণ আত্মবিশ্বাসী সুস্মি বলল, ‘আমি নাচও পারি। আপনাকে নাটকের একটা সংলাপ শোনাই?’ এ কথা বলেই ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর একটি সংলাপ আওড়ানো শুরু করল, ‘ও খালাম্মা, কই তুমি?/মেঘ নামানো চাল দাও।’

ভিটিসির প্রিন্সিপাল নূরজাহান দীপা জানালেন, সাফওয়ান ও সুস্মির বড় গুণ হলো, ‘মঞ্চে যদি কেউ ভুল করে বসে তাৎক্ষণিকভাবে সেটা সামাল দিতে সাহায্য করে ওরা।’

সুস্মির মা শিরিন হাফিজ বললেন, ‘আগে যারা কথা শোনাত, এখন তারাই মেয়েটার অভিনয়ের প্রশংসা করে। মা হিসেবে এর চেয়ে বেশি কী চাওয়ার থাকতে পারে, বলুন?’

তাদের বন্ধুরা
নাটকে সংলাপবিহীন কিছু দৃশ্য আছে। যারা বলার দিক থেকে পিছিয়ে, তারা এসব দৃশ্যে অভিনয় করেছে। যেমন—তাহসানের কথাই ধরা যাক। নাটকে দইওয়ালা হিসেবে শুধু দইয়ের ভাঁড় নিয়ে মঞ্চে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হয় তাকে। সে বলল, প্রথম দিকে খুব কাঁদতাম। এখন ভালো লাগে।’ সাজুর মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছে কেতকী ইরাম ইলিয়াস। সে বলল, ‘নাটকে সাজু কান্নাকাটি করলে জড়ায়ে ধরে সান্ত্বনা দিই আমি।’

সায়ন্তন চক্রবর্তীর হাইপার অডিটরি এবং আলোর সেন্সিটিভিটি আছে। কিন্তু ঢোল বাজায় দারুণ। বাজানোর পাশাপাশি সায়ন্তন মঞ্চের পেছনে থেকে সাজু ও রূপাইয়ের পরিচয় বর্ণনা করেছে। লিথীর গানের গলা দারুণ। মেহেজাবিন ও মারিয়া নাচে খুব ভালো।

ওদের উপযোগী করেই সব করা
শিক্ষকরা প্রশিক্ষণার্থীদের কথা চিন্তা করেই নাটকের সেট ও প্রপস তৈরি করেছেন। শিক্ষার্থীদের কে ঘুড়ি ওড়াবে, কে জেলে হয়ে মাছ ধরার জাল নিয়ে যাবে, আবার কার গ্রস-মটর এবং ব্যালান্সিং ভালো, যে দইয়ের হাঁড়ি, ঝোলা নিয়ে যাবে, কে লাঙল-গরু টেনে নেবে—এভাবে একেকজনের ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

শিক্ষকরা বললেন
সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। নির্দেশনা দিয়েছিলেন আমীর হোসেন ও নূপুর নাহার। আমীর হোসেন বললেন, স্টেজ ফোবিয়া তো বটেই, অনেকের সাউন্ড, লাইটসহ মঞ্চের নানা বিষয়ে স্পর্শকাতরতা আছে। তাদের এই ভয় দূর করতে মঞ্চে নিয়ে গিয়ে অভিনয় দেখিয়েছি। তা ছাড়া যেকোনো নাটক মঞ্চায়ন করার আগের দিন মঞ্চে নিয়ে তাদের কমপক্ষে দুইবার মহড়া দেওয়া হয়। একবার ড্রেস ও প্রপসসহ। আরেকবার এগুলো ছাড়া।

নূপুর নাহার বললেন, ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিসের সঙ্গে অভ্যস্ত করানোই মূল চ্যালেঞ্জ। ধরুন, নাটকের একটি দৃশ্য আছে পাখি উড়ে যাচ্ছে। নায়িকা উদাস নয়নে সেই পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। এ ধরনের বিমূর্ত বিষয়ে তাদের অভ্যস্ত করতে কষ্ট হতো।’

আরেক শিক্ষক আদিব মজলিশ খান জানালেন, ‘জলপরি ও কাঠুরে’ নামে নতুন একটি নাটক নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা। এখন শিক্ষার্থীরা অনেক পরিণত।’

এটা একটা যুদ্ধ
প্রতিবন্ধিতা তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। শুধু একটু বাড়তি চেষ্টা আর হেরে না যাওয়ার প্রত্যয়—এই সম্বলেই আজ মঞ্চে আলো ছড়াচ্ছে কারিশমা। যেমনটা বলছিলেন সাজিদা রহমান ড্যানি—‘এই শিশুদের মঞ্চে নিয়ে আসাটা একটা যুদ্ধের শুরু বলতে পারেন। প্রথমে অভিভাবকদের অনেকে পাশে ছিলেন। অনেকে পাত্তা দেননি। কিন্তু আমরা থেমে থাকিনি।

অনেক অভিভাবক এ ধরনের সন্তানদের থেরাপির জন্য ছোটাছুটি করেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না নাচ, গান কিংবা অভিনয়ের মতো কোনো একটা সৃজনশীল কাজে তাঁদের সন্তানদের জন্য কতটা কার্যকর থেরাপিউটিক চিকিৎসা হচ্ছে।’

পথটা ভীষণ কঠিন
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে নাটক মঞ্চায়নে চ্যালেঞ্জ ভূরি ভূরি। পৃষ্ঠপোষকতার সমস্যা প্রকট। এখন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কিছু অনুদান পায় কারিশমা। এতে বছরে একটি নাটক মঞ্চায়ন করতে পারে। সাজিদা রহমান ড্যানি বললেন, ‘অপার সম্ভাবনার এই দলটি দেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিল্পীদের পথপ্রদর্শক। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা ভুবন জয় করতে পারবে।’