যেকোনো সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সেই সমাজের মানুষের অধিকারে প্রবেশগম্য নিশ্চিত করা ও অধিকার আদায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে অধিকারের ধারণা ও আওতা নিয়ে। যদিও এটি একটি ধারাবাহিক বিষয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয় এবং স্থান-কাল-পাত্র দ্বারা নির্দেশিত হয়। যেমন আমাদের ভোটের অধিকার মাত্র সেদিনকার। আজ যেটা অত্যাবশ্যকীয় ও মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত সেটাই হয়তো এক দিন ছিল চিন্তারও বাইরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৮৬৫-৭০ সালে সংবিধানের দশম, চৌদ্দতম ও পনেরোতম সংশোধনীর মাধ্যমে যদিও নারীরা তখনো ভোটাধিকার পাননি। মার্কিন মুল্লুুকে নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সংবিধানের ঊনিশতম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯২০ সালে। আমেরিকায় যখন একের পর এক অধিকারের আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল ও স্বীকৃতি পাচ্ছিল ঠিক তখনই ভারত, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠীকে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ে লড়তে হচ্ছিল, অঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছিল ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের হাতে। সেই সময় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন উত্থাপন করাই ছিল রাজদ্রোহ, রাজা যা দেবেন তাতেই কৃতজ্ঞ হওয়াই ধারণা ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুদের মূল প্রচারণা। মানবতার প্রতি মহান দায়িত্বপালনেই যেন বিশ্বের এই দেশগুলোতে উপনিবেশ স্থাপন করতে হয়েছে, সেটাই ছিল ন্যারেটিভ।
মানুষ এখন আর শুধু ভৌত সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করে না। এর পাশাপাশি সাইবার জগতে এখন মানুষের পদচারণা মানুষের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক নতুন ধারণা। এটাই হচ্ছে ডিজিটাল ভুবন। এ এক এমন জগৎ যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু এই জগতে বিচরণ বাস্তবের তুলনায় কোনো অংশে কম নয় বরং সেখানে অনেক দ্রুততম উপায়ে অন্যের কাছে পৌঁছানো যায়। আজকের এ সময়ে অগ্রগতি ও উন্নতির একটি বড় সূচক হচ্ছে সাইবার জগতের ওপর দখল ও এর ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিস্তৃতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করে। এটা শুধু জনগণের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের বিষয় নয়। প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ এখন অভ্যন্তরীণ, বিশ্ব ও ভূ-রাজনীতিরও অংশ। কার হাতে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ সেটাই এখন মুখ্য বিষয়। সমাজে যারা চুনোপুঁটি তাদের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এর অংশ হয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারা। আর সেই আলোচনাই তথ্যপ্রযুক্তিতে অধিকারের আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো খুব ভালোভাবে বোঝা দরকার। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই এখনো ডিজিটাল সাক্ষরতা থেকে বাইরে, যেমন তারা বাইরে কম্পিউটার ও ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার থেকে। সাক্ষরতা ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে জনগণের একটা বড় অংশ ডিজিটাল বৈষম্যের শিকার হয়, যা তাদের প্রান্তিকতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আর জন্য সব পর্যায়ে যেমন অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে এবং আছে সক্ষমতার ঘাটতি, তেমনি একই সঙ্গে আছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক ইকোসিস্টেমের। অন্যদিকে সাইবার স্পেসে পদচারণার জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় আর্থিক সক্ষমতা ও অর্থব্যয় একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিএসের এক জরিপ অনুযায়ী দেশের ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সেবাকে ব্যয়বহুল মনে করে। পাশাপাশি এই জরিপ অনুযায়ী দেশে মাত্র ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং দেশের কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষ আইসিটি ব্যবহারে যেমন বেশ পিছিয়ে, তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষও পিছিয়ে।
পাশাপাশি আমাদের সমাজব্যবস্থায় সাইবার ওয়ার্ল্ডে নারীর অংশগ্রহণকে এখনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়, যা সামাজিক ট্যাবুর এক নতুন ক্ষেত্র। অধিকন্তু যারা এতসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিজের পদচিহ্ন রাখার চেষ্টা করে তারাও নানা ধরনের সাইবার-সহিংসতা বা বোলিংয়ের শিকার হয়। অন্যদিকে সাইবার ওয়ার্ল্ডে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হওয়া, নানা ধরনের হুমকি ও বিধিনিষেধ আরোপ এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। এত রকমের সংকট ও প্রতিবন্ধকতা সাইবার জগতে অংশগ্রহণে অধিকারহীনতা তৈরি করে, যা একই সঙ্গে অন্যান্য মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েই তথ্যপ্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ অন্যান্য মানবাধিকারের মতো একটি মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। বর্তমান বাস্তবতায় একে শুধু একটি সুযোগ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই, দেখতে হবে মানবাধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে। এই অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া দরকার সবার আগে, পাশাপাশি এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে এই অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তবে তারও আগে দরকার সাইবারে জগতে অংশগ্রহণে সবার জন্য বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাস্তব প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা। সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলছে। সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ডিজিটাল অধিকারের স্বীকৃতির আদায় এবং এর বাস্তবায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ বাংলাদেশ তখনই স্মার্ট হবে যখন এর জনগণ স্মার্ট হবে এবং স্মার্ট হবে এর ব্যবস্থাপনা।
ডিজিটাল অধিকার যেমন বর্তমান বিশ্বে অধিকারের আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, একই সঙ্গে এই আলোচনার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নানা ধরনের উদ্যোগ। জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, সাধারণভাবে প্রযোজ্য সব মানবাধিকার ডিজিটাল জগতের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। জাতিসংঘ বলছে, ডিজিটাল প্রযুক্তি মানবাধিকার চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় কিন্তু প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারও করা হয়। তথ্য সুরক্ষা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা, নজরদারির প্রযুক্তির অপব্যবহার, অনলাইন সহিংসতা ও হয়রানি ইত্যাদি বিষয়সমূহই এ ক্ষেত্রে মূল আশঙ্কার বিষয়।
ডিজিটাল অধিকার বাস্তবায়নে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সেসব এখানে তুলে ধরা হলো। এগুলো হলো : সাইবার স্পেস সম্পর্কিত সব আইনি কাঠামো তৈরিতে মানবাধিকারকে কেন্দ্রীয় বিবেচনায় নেওয়া; সাইবার জগতে মানবাধিকার চর্চা সম্পর্কিত প্রায়োগিক গাইডলাইন তৈরি; বিকাশমান ডিজিটাল প্রযুক্তির বিবেচনায় সুরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নেওয়া; ঢালাও ইন্টারনেট শাটডাউন ও প্রতিবন্ধকতা তৈরিকে নিরুৎসাহিত করা; তথ্যের সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন ও এর প্রয়োগ; ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় উদ্যোগ, ব্যক্তির ডিজিটাল সত্তা ও পরিচয়ের সুরক্ষা প্রদান; বেআইনি ও অপ্রয়োজনীয় নজরদারি থেকে সুরক্ষা দেওয়া; বেআইনি ও ক্ষতিকর কনটেন্ট প্রতিরোধে মানবাধিকারভিত্তিক আইনি কাঠামো ও প্রক্রিয়া পরিচালনা; নিরাপদ পরিসর, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক কনটেন্ট গভর্নেন্স ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। আজকের বাংলাদেশের এই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যেখানে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, সেখানে ডিজিটাল অধিকারের এই বিষয়গুলো কতটুকু অগ্রাধিকারের দাবি রাখে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: নাজমুল আহসান, উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট