বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অপপ্রচার ও বাস্তবতা

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অর্থনৈতিক অঙ্গনে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বিগত দিনে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্রতি কিছুটা নিচে নেমে এলে রিজার্ভ-সংক্রান্ত আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। করোনা মহামারি এবং পরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাবে উত্তঙ্গ গতিতে ছুটতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খানিক শ্লথ হয়েছে। টান পড়েছে ঊর্ধ্বমুখী ছুটতে থাকা রিজার্ভে। সরকার ইতিমধ্যে বিলাসী পণ্য আমদানির রাশ টেনে ধরাসহ বহুবিদ প্রতিকারমূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। ইতিবাচক ফলও আসতে শুরু করেছে। তথাপি, সভা-সেমিনার আর চায়ের কাপে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে রিজার্ভ। ‘গেল গেল, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে গেল’ রব নিয়েও হাজির হয়েছেন অনেকে।

রিজার্ভের সংজ্ঞা বুঝতে গিয়ে আমরা খুঁজে পাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কর্তৃক ২০ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে প্রকাশিত ‘Guidelines for Foreign Exchange Reserve Management’ শীর্ষক প্রতিবেদন, যেখানে রিজার্ভকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ‘Reserves consist of official public sector foreign assets that are readily available to and controlled by the monetary authorities’ হিসেবে। রিজার্ভ মূলত কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রক্ষিত তাদের নিজস্ব সম্পদ, যা তাত্ক্ষণিকভাবে বিনিময়যোগ্য এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে দেনা-পাওনা মেটানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। সাধারণত স্বর্ণ, ডলার অথবা ইউরোর মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো মুদ্রা রিজার্ভ আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত থাকে।

স্বর্ণ কখন থেকে রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আর ‘খড়ম পায়ে গঙ্গা পার হওয়া’ এক কথা। তবে সবাই জানি ও মানি যে, প্রাচীনকাল থেকেই স্বর্ণ অতি মূল্যবান ধাতু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী কার্ল মার্ক্স তার ঐতিহাসিক ‘Critique of Political Economy-1859’–এ স্বর্ণকে মানুষের আবিষ্কৃত প্রথম ধাতু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং অর্থনীতিতে স্বর্ণের ঐতিহাসিক প্রভাব তুলে ধরেছেন।

রিজার্ভ হিসেবে স্বর্ণের একচ্ছত্র আধিপত্য টিকে ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন মোতাবেক স্বর্ণের প্রভাব কাটিয়ে ডলারের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্রেটন উডস সিস্টেম’ থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্তকে প্রণিধান হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে ব্রেটন উডস সিস্টেম থেকে একতরফাভাবে বের হয়ে যায়। ফলে স্বর্ণের সঙ্গে অন্যান্য দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে ডলারের তুল্যমান নিরূপণের পদ্ধতি অকজো হয়ে পড়ে। সেই থেকে উত্থান ঘটতে থাকে ডলারের। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১

সালের নভেম্বরে ইউরোপের ১০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে রোমে অনুষ্ঠিত জি-১০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী (ট্রেজারি সেক্রেটারি) জন বাউডেন কনালির বিখ্যাত উক্তি ‘The dollar is our currency, but it is your problem’ আজও বহুল আলোচ্য।

ডলার তথা কোনো একটি একক মুদ্রার ওপর অতিনির্ভরশীলতা উদ্ভূত ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে আইএমএফ ১৯৬৯ সালে SDR (Special Drawing Rights) নামক বিশেষ মুদ্রা ঝুড়ির প্রবর্তন করে। এসডিআর একক কোনো মুদ্রা নয়, বরং পাঁচটি মুদ্রা নিয়ে গঠিত মুদ্রার মিশ্রণ অথবা মুদ্রাঝুড়ি (Basket of Currencies)। ঝুড়িতে কোন মুদ্রা কী পরিমাণে থাকবে প্রতি পাঁচ বছর পর পর আইএমএফ কর্তৃক নির্ধারিত হয়। সর্বশেষ ১ আগস্ট ২০২২ তারিখ থেকে কার্যকর প্রতি ঝুড়ি এসডিআরে ৪৩.৩৮ ভাগ থাকে ইউএস ডলার, ২৯.৩১ ভাগ ইউরো, ১২.২৮ ভাগ চীনা ইউয়ান, ৭.৫৯ ভাগ জাপানিজ ইয়েন এবং ৭.৪৪ ভাগ থাকে ব্রিটিশ পাউন্ড। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এসব মুদ্রার মোট মান যোগ করে এক এসডিআরের মান নিরূপণ করা হয়।

আইএমএফের ডাটা মোতাবেক ২০২২ সালের তৃতীয় ভাগে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশের হাতে ১১,৫৯৮.৬৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে। তাছাড়া ওয়ার্ল্ড গোল্ড পরিষদের প্রতিবেদনমতে উক্ত সময়ে ৩,১৯৪.০৮৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করে চীন আছে তালিকার সবার ওপরে। তালিকায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা জাপান, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভের পরিমাণ যথাক্রমে ১২৩৮.০৫৪, ৯৪৭.৬১০ এবং ৬৫৬.২৭৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের রিজার্ভ। ৩৬.৫১৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। বাংলাদেশে স্বর্ণের মজুতের পরিমাণ প্রায় ১৪.০৩ টন, যার মূল্যমান ৭৫৪.২৪ মিলিয়ন ডলার। কোনো দেশ স্বীয় দেশেরই কোনো ব্যাংকে বা বিদেশে অবস্থিত কোনো ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সংরক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশের ব্যাংকের রিজার্ভও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভোল্টে রক্ষিত আছে।

রাষ্ট্রসমূহ সাধারণত বিদেশ থেকে রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স এবং ঋণ ও অনুদান—এই তিন খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি খাত থেকে আয় করেছে প্রায় ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা সমমানের ৫২.৪৬৯ বিলিয়ন ডলার।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত আমদানি মূল্য এবং বৈদেশিক ঋণ, ঋণের সুদ ইত্যাদি পরিশোধে ব্যবহৃত হয়।

পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছাড়া একটি দেশ জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করতে পারে না। আর্থিক বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ, মুদ্রানীতি জোরদারকরণ, বাজেট বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৃহৎ প্রকল্পে অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ব্যবহৃত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার মাধ্যমে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সংকটকালে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস জোগায় রিজার্ভ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী যে পরিমাণ রিজার্ভ রক্ষিত আছে, তা দিয়ে গড়ে ১১ মাসের বৈশ্বিক আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে বর্তমানে মোজাম্বিকের হাতে সবচেয়ে বেশি ৭৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ সংরক্ষিত আছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয়ের হাতেই মাত্র ২ (দুই) মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ সংরক্ষিত আছে। একই প্রতিবেদন মোতাবেক অন্তত ২৫টি দেশের হাতে বর্তমানে এক মাস অথবা এক মাসের কম দিনের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদনি ব্যয় মেটানোর মতো অর্থ ছিল, বর্তমানে তা কিছুটা কমে এসেছে। বেশি বেশি রিজার্ভ হাতে ধরে রাখলেই অর্থনীতির অবস্থা ভালো হবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, কোনো দেশে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকলে সেটা মোটামুটি নিরাপদ। তাছাড়া, কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য রিজার্ভই একমাত্র মানদণ্ড নয়। তাই বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার একান্তই কিছু নেই, বরং সতর্ক হওয়ার উপাদান আছে।

বছর-বছর রিজার্ভ বাড়ানোর চেয়ে অর্থনৈতিক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখা, পাচার ও অপচয় রোধ, দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা বিরাজমান রাখা খুবই জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমে থাকাও অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে মনে করা হয়। কারণ, অতিরিক্ত রিজার্ভ অকারণ ফেলে রাখা অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়া এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি আশানুরূপ না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে। দক্ষ ও স্মার্ট সরকার রিজার্ভ অহেতুক ফেলে না রেখে লাভজনক কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের রিজার্ভ সন্তোষজনক মাত্রায় পৌঁছালে সরকার রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত ৫৮ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঋণ নিয়ে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল (বিআইডিএফ) এবং রপ্তানি ঋণ তহবিল (ইডিএফ)। বিআইডিএফ থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে পায়রা বন্দর উন্নয়নে, নদী ড্রেজিংয়ের কাজে। সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে প্রথম বারের মতো রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে।

বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় বর্তমান সরকার বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে। টেকসই ঋণব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হচ্ছে মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো উৎপাদনশীল খাতে। রেমিট্যান্সে প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কারিগরি ও আইটি শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে। রপ্তানি বাস্কেটে নতুন নতুন পণ্য যোগ করার লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ আগাচ্ছে দ্রুতগতিতে।

বর্তমান সরকারের আমলে প্রথম বারের মতো দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ আগস্ট, ২০২১ তারিখ অতিক্রম করেছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। ৩০ জুন ২০০৬ তারিখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৩.৪৮৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ১ জুলাই ২০২২ তারিখে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১.৮২৭ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সদ্ব্যবহার করে আসছে বিচক্ষণতার সঙ্গে। তাই রিজার্ভ নিয়ে অহেতুক গুজবে কান দিয়ে শঙ্কিত না হয়ে আত্মবিশ্বাসে শামিল হতে হবে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সব বাধা অতিক্রম করে ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’র বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ অর্জনের অদম্য অভিযাত্রায়।

লেখক : ড. মনসুর আলম খান
জেলা প্রশাসক, মেহেরপুর