ফেব্রম্নয়ারি মাস বাদ দিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ সন্তোষজনক থাকলেও পরবর্তীতে এ ধারায় মন্দা দেখা দেয়। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এ সময় খোলা বাজারে হু হু করে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং ষড়যন্ত্রকারী চক্রের নানামুখী গুজবে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর মিছিলে যোগ দেন। এতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় পতন দেখা দেয়। তবে বেগতিক পরিস্থিতি সামলাতে সরকার বৈধ উপায়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজীকরণ, অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা দেওয়াসহ একগুচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে হুন্ডির পাগলা ঘোড়ার লাগাম বেশ খানিকটা টেনে ধরা সম্ভব হয়। বছরের শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের স্বস্তির ধারায় ফিরেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখনো প্রবাসীদের অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। চলতি বছরে বিদেশে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী পাঠানো এবং দেশে আসা রেমিট্যান্সের তথ্য চিত্র বিশ্লেষণে এ চিত্র স্পষ্ট। তবে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যাপারে সরকার যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার গতি অনেকটা বাড়িয়েছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের সংকট দ্রম্নতই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর টানা দুই মাস বড় পতনের পর গত নভেম্বরে রেমিট্যান্সের সূচক বাড়তে শুরু করে। যা ডিসেম্বরে উলস্নম্ফনের ধারায় ফিরে। হুন্ডি বন্ধসহ নানা পদক্ষেপের পর নভেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আর ডিসেম্বরের প্রথম ১৬ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৯৪ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। যা গড়ে প্রতিদিন ৫ দশমিক ৮৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ এ গতি অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বর শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৮০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অথচ অক্টোবরে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আর সেপ্টেম্বর মাসে এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে অক্টোবর ও সেপ্টেম্বরে প্রতিদিন এসেছিল যথাক্রমে ৪ কোটি ৯২ লাখ ও ৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার। অথচ জুলাই ও আগস্টে দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭ কোটি ডলার করে রেমিট্যান্স আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে দেশে। এ মাস শেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন \হবাংলাদেশি প্রবাসীরা। আগস্ট মাসে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলার। জুনে প্রবাসীদের পাঠানো ১৮৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাওয়া গেছে। মে মাসে প্রবাসীরা মোট ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগে এপ্রিল মাসে ২০০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার এবং মার্চ মাসে ১৮৬ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি বছরের প্রথম দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রম্নয়ারিতে যথাক্রমে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার এবং ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় পতনের পর টনক নড়ে সরকারের। এর ধারাবাহিকতায় বেশকিছু কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে নভেম্বরে ইতিবাচক ধারায় ফেরে রেমিট্যান্স। ডিসেম্বরে সেই ধারা আরও ইতিবাচক হওয়ায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আশা, জুলাই ও আগস্টের মতো ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারে পৌঁছবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলের বদলে অবৈধভাবে হুন্ডিতে অর্থ পাঠানোর কারণ, সেখানে ডলারের দর বেশি পাওয়া যায়। প্রতি ডলারের বিপরীতে তিন থেকে চার টাকার ব্যবধান অনেককেই এভাবে অর্থ পাঠানোয় আগ্রহী করে তোলে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বেশ খানিকটা কমে যায়। তবে হুন্ডি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পর পরিস্থিতি ফের স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে রেমিট্যান্সের ধারা পতনমুখী হওয়ায় হুন্ডি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্সের ২৩০ জন বেনিফিশিয়ারির হিসাবে সাময়িকভাবে উত্তোলন স্থগিত করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ভবিষ্যতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাবে এমন প্রতিশ্রম্নতি দিলে হিসাবগুলো খুলে দেওয়া হবে বলে জানায় বিএফআইইউ। এছাড়া বৈধ উপায়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজ করা, অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা ও রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে। সবশেষ বিদেশ থেকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে আরও বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বিকাশ, রকেট ও উপায়ের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সরাসরি প্রবাসী আয় আনার সুযোগ করে দেওয়া অন্যতম।
এর আগে গত ২৯ নভেম্বর এক সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এখন থেকে প্রবাসীরা ঘরে বসেই মোবাইলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন। হুন্ডি ঠেকাতে রেমিট্যান্স আনার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নতুন উদ্যোগে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো কিছুটা বন্ধ হলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের পথ এখনও অনেক দূর বলে মনে করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, নানা পদক্ষেপে কিছুটা লাগাম টেনে ধরা গেলেও এখনও হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার হচ্ছে। গত এক বছরে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথমভাগে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল হুন্ডি কারবার করা ১৬ জনকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য দেন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত ১৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে তারা ৪ মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জন বিকাশ এজেন্ট, তিনজন বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার, তিনজন বিকাশের ডিএসএস, দুইজন হুন্ডি এজেন্ট, একজন হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী ও একজন হুন্ডি পরিচালনাকারী।
সিআইডি প্রধান আরও জানান, এমএফসের মাধ্যমে হুন্ডি করে এমন ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের ৫ হাজার এজেন্ট এমএফএস মাধ্যমে হুন্ডির সঙ্গে জড়িত। এসব এজেন্ট ৪ মাসে ২৫ হাজার কোটি এবং বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।