পার্বত্য অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি

বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। সরকারের এহেন নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ অনাবাদী জমি আবাদের আওতায় আনতে এবং চাষাবাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্যঞ্চল দেশের এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত। পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর।

বৈচিত্র্যময় এ কৃষিকে ঘিরেই বেশিরভাগ পাহাড়ি মানুষের জীবন চলে। পাহাড়ি কৃষিকে ঘিরে রয়েছে সরকারের নানামুখী কর্মপরিকল্পনা। আর এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। পৃথিবীর অনেক দেশের কাছে বাংলাদেশের কৃষি এখন রোল মডেল। সরকারের কৃষিবান্ধব বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা, কৃষক-কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলটির কৃষি অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে। পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

জাতীয় এক দৈনিকের সংবাদমতে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত ৫ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে। প্রকৃতি ও বিরাজমান ফসলের ক্ষতি না করে এসব অনাবাদি জমি কফি ও কাজুবাদাম চাষের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে, এই দুই ফসল থেকে বছরে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের জন্য এক মাইলফলক হবে।

কাজুবাদাম ও কফি আমদানিনির্ভর হওয়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শুধু কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার কেজি। দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ কফি আমদানি করতে হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৫১৭ মেট্রিক টন গ্রিন কফি আমদানি করতে হয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু কফি ও কাজুবাদাম আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেওয়া কাজুবাদাম ও কফি চাষ প্রকল্পটি পুরোপুরি সফল হলে এ দুটো ফসলের আমদানিনির্ভরতা কমবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এর জন্য কাজুবাদাম ও কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে আরও বেগবান করা দরকার। তাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানারকম ফল সরবরাহ হয়ে থাকে। এ এলাকার ফল ও বিভিন্ন মসলা ফসলের আলাদা গুণ ও বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। প্রতিবছর এ অঞ্চলে ফলের উৎপাদন বাড়ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙ্গমাটি অঞ্চল, ২০২২-এর তথ্যানুসারে তিন পার্বত্য জেলায় ২০২০-২১ সালে ফলের মোট আবাদ এলাকা হিসাব করা হয়েছে ৯৯ হাজার ৪৬৭ দশমিক ৫ হেক্টর, যার মোট উৎপাদন ১৬ লাখ ৮৫ হাজার ৫২৯ মেট্রিক টন। টাকার হিসাবে মোট মূল্য ১৮০৭ কোটি ৪২ লাখ ৯ হাজার। ওই তথ্যানুসারে অন্যান্য ফলসহ ৪৫ রকমের প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের আবাদ হতে দেখা যায়। যার মধ্যে প্রায় ২৭ রকমের রয়েছে অপ্রচলিত ফল। বাকিগুলো প্রচলিত ফল।

ওই সূত্রমতে, ২০২০-২১ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় ফলের মোট আবাদ এলাকা ৩৫ হাজার ১১৮ হেক্টর, যার মোট উৎপাদন ৬ লাখ ৫ হাজার ৩০০শ’ মেট্রিক টন। একই সময়ে খাগড়াছড়ি জেলার ফলের মোট আবাদ এলাকা ১৮ হাজার ২১৮ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন। একই সময়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ফলের মোট আবাদ এলাকা ৪৫ হাজার ৯৩২ হেক্টর, যার মোট উৎপাদন ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭১ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।

এসব ফল বেশিরভাগ আবাদ হয় পাহাড়ে ঢালুতে বাগান আকারে। বসতবাড়ির আশপাশেও অনেক ফল আবাদ হতে দেখা যায়। বিগত দশক থেকে পার্বত্য অঞ্চলে আমের নীরব বিপ্লব ঘটেছে। একসময় উত্তরাঞ্চল থেকে আম পাহাড়ে আসত। এখন পাহাড়ের আম দেশের প্রায় সব জায়গায় যাচ্ছে। পাহাড়ি আমের আলাদা সুখ্যাতি রয়েছে।

পাহাড়ে আবাদকৃত আমের জাতের মধ্যে বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-৮, ব্যানানা ম্যাংগো বেশ সাড়া ফেলেছে। বিদেশ থেকে অনেক রঙিন জাতের আমও আবাদ হচ্ছে। এসব বিদেশী আম গবেষণার নজরে নিয়ে আসা জরুরি। অন্যথায় বিদেশ থেকে আসা অজানা রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙ্গামাটি অঞ্চল, ২০২২-এর তথ্যানুসারে তিন পার্বত্য জেলায় ২০২০-২১ সালে আমের উৎপাদন এলাকা ১৪ হাজার ৫৩৮ হেক্টর, যার মোট উৎপাদন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮০৪ মেট্রিক টন। উহার মোট আর্থিক মূল্য ১৬৪ কোটি ৮০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

ওই বছরে কাঁঠালের মোট উৎপাদন ২ লাখ ৬২ হাজার ৫০১ হেক্টর, যার আর্থিক মূল্য ১৩১ কোটি ২৫ লাখ ৫ হাজার টাকা, লিচুর মোট উৎপাদন ৩০ হাজার ৮২১ মেট্রিক টন, যার মোট মূল্য ৩০ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার টাকা, কলার মোট উৎপাদন ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৯ মেট্রিক টন, যার মোট আর্থিক মূল্য ৫৭৬ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার টাকা, পেয়ারার মোট উৎপাদন ৩৪ হাজার ৪৩২ মেট্রিক টন, যার মোট মূল্য ৩৪ কোটি ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকা হিসাব করা হয়েছে।

রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবানের আনারসের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। রাঙ্গামাটিতে হানিকুইন এবং বান্দরবানে জায়ান্টকিউ জাতের আনারস আবাদ হয়। তিন পার্বত্য জেলায় আনারসের মোট উৎপাদন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৮৪ মেট্রিক টন, যার মোট আর্থিক মূল্য ২৬০ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পাহাড়ি পেঁপের কদর রাজধানীসহ সারাদেশে।

এ পেঁপের মোট উৎপাদন ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫২ মেট্রিক টন, যার মোট মূল্য ২৫২ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। রুমার এবং সাজেকের কমলার জুড়ি মেলা ভার। এ কমলার মোট উৎপাদন ১৬ হাজার ৪০৭ মেট্রিক টন, যার মোট আর্থিক মূল্য ৪৯ কোটি ২২ লাখ ১০ হাজার টাকা। বারি মাল্টা-১ পাহাড়ি এলাকায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। ওই সময়ে তিন পার্বত্য জেলায় মাল্টার মোট উৎপাদন ১১ হাজার ৮২৯ মেট্রিক টন, যার মোট মূল্য ২৯ কোটি ৫৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

পাহাড়ে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন দেখে অনেকের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এ বাতাবিলেবুর মোট উৎপাদন ২৫ হাজার ৫০৬ মেট্রিক টন, যার মোট মূল্য ২০ কোটি ৪০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ড্রাগনফল পাহাড়ে একটি নতুন সংযোজন এবং সম্ভাবনাময় ফল। এ ফলের মোট উৎপাদন ৩৪৮ মেট্রিক টন, যার মোট আর্থিক মূল্য ৪ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া অন্যান্য ফলের আর্থিক মূল্য হিসাব করলে পাহাড়ের কৃষি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে নিঃসন্দেহে।

পাহাড়ে জুম চাষ একটি আদি চাষাবাদ পদ্ধতি হলেও এটি উপজাতি সম্প্রদায়ের আত্মার বন্ধন। জুম চাষেরও অর্থনীতি আছে। জুম চাষকে ফুড ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। একই পাহাড়ে একই সঙ্গে অনেক ফসল পাওয়া যায় বলে অনেক উপজাতি এ জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। তবে ইদানীং জুম ফসলের ফলন কম হওয়া, জুম চাষের জন্য পাহাড় না পাওয়ার কারণে অনেকে স্থায়ী ফলদ বাগানের দিকে ঝুঁকছে অথবা অন্য কোনো লাভজনক পেশায় নিয়োজিত থাকছে।

২০০৯ সালে জুম চাষ ও পাহাড়ি খামার পদ্ধতির আর্থ-সামাজিক প্রভাব বিষয়ে আমার নিজের পিএইচডি গবেষণায় দেখা যায়, একই পাহাড়ে ওই সময় প্রায় ১৮ রকমের ফসল হতো। বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫/৬টিতে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো অনেক উপজাতি জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় কৃষি নীতিমালা ২০১৮-এর ৯.৩.১ উপ-অনুচ্ছেদে পরিবেশবান্ধব জুম চাষের উপযোগী আধুনিক জাত ও প্রযুক্তি উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদারকরণ করার কথা বলা হয়েছে।

উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল ছাড়াও পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতিতে আদা ও হলুদ চাষের ভূমিকা অনবদ্য। কৃষি সম্প্রসারণ, রাঙ্গামাটি অঞ্চলের তথ্যানুসারে ২০২০-২১ সালে তিন পার্বত্য জেলায় ৭ হাজার ৩৮২ হেক্টর জায়গায় আদার চাষ হয়, যার মোট উৎপাদন ৮৮ হাজার ৭৯৪ মেট্রিক টন। দেশে-বিদেশে খাগড়াছড়ির হলুদের ব্যাপক সুখ্যাতি রয়েছে।

তিন জেলায় হলুদের মোট আবাদ এলাকা ৮ হাজার ৭৪৭ হেক্টর, যার মোট উৎপাদন ৩০ হাজার ১৮২ মেট্রিক টন। বারি উদ্ভাবিত অনেক হলুদের জাত রয়েছে। এসব জাতের চাষ বৃদ্ধি করা গেলে মোট উৎপাদন আরও বাড়বে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অপচনশীল মসলা জাতীয় ফসল যেমন- তেজপাতা, দারুচিনি, আলুবোখারা, গোলমরিচ চাষ করলে বাজারজাতকরণে সুবিধা বাড়বে।

আখ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি ফসল। পাহাড়ের পাদদেশে ভ্যালিতে আখ ভালো জন্মে। ইদানীং ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র আখ থেকে গুড় তৈরিসহ বহু ভ্যালু এডেড পণ্য তৈরি করছে। এ গুড়ের কদর ও সুনাম রয়েছে। পাহাড়ি এলাকার তুলার বেশ কদর রয়েছে।

পাহাড়ি এলাকায় ভ্যালি বা সমতল জায়গায় প্রধান ফসল ধান চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম শাকসবজি আবাদ হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ, রাঙ্গামাটি অঞ্চল তথ্যানুসারে তিন পার্বত্য জেলায় ২০২১-২২ সালে খরিপ-১ মৌসুমে আউশের মোট উৎপাদন (চালে) ৪৪ হাজার ১০ মেট্রিক টন। বোরো ধানের মোট উৎপাদন (চালে) ১ লাখ ৭ হাজার ৩১০ মেট্রিক টন।

একই বছর খরিপ-২ মৌসুমে আমন ধানের মোট উৎপাদন (চালে) ১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন। এসবের আর্থিক মূল্য হিসাব করলে পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতি কোনো অংশে কম নয়। তামাক চাষের কারণে অনেক সবজি চাষের আওতাধীন জমি কমে গেছে। তামাকের বিকল্প হিসাবে লাভজনক শস্যপর্যায় প্রবর্তন দরকার। বিপণন সুবিধা বাড়িয়ে আন্তঃফসলের সহিত ইক্ষু, ভুট্টা চাষ করা যেতে পারে।

এফএওর ২০১৯ তথ্যমতে, বন্যাবিধৌত ও ভ্যালি ভূমির পরিমাণ প্রায় ২,৭০,৮১২ হেক্টর যা সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের শতকরা ৩ দশমিক ২ ভাগ। যার মাত্র শতকরা ১৯ ভাগ জমিতে সেচ সুবিধা বিদ্যমান। এখানের প্রধান শস্যপর্যায় হলো বোরো ধান-পতিত-বোনা আমন এবং সবজি-বোনা আউশ-বোনা আমন। এসব শস্যপর্যায়ে স্বল্পজীবনকালীন সরিষাজাত আবাদ করা গেলে তৈল ফসলের আধিক্য বাড়বে।

পাহাড়ি কৃষি অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে হলে মানসম্মত উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। সে সঙ্গে কৃষক পর্যায়ে ভ্যালু এডিশনের সুযোগ বাড়িয়ে ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় কমিয়ে আনা জরুরি। তিন পার্বত্য জেলায় ইন্টিগ্রেটেড ফার্ম ম্যানেজমেন্টের আদলে কৃষির সকল সেক্টরের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি সমন্বিত টেকসই পাহাড়ি কৃষি প্রযুক্তি ভিলেজ করা যায় কি-না ভেবে দেখা যেতে পারে। সে সঙ্গে দক্ষ ও কার্যকর সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতি আরও সুদৃঢ় হবে।

লেখক : ড. মো. জামাল উদ্দিন
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি; সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও, জাতিসংঘ