৮ ভোগ্য পণ্য আমদানির জন্য বিশেষ উদ্যোগ

রমজান ঘিরে ভোগ্য পণ্য আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে এসব পণ্যের ঋণপত্র খুলতে মার্জিন ন্যূনতম রাখা, রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ, বাকিতে এসব পণ্য কেনার সুযোগ এবং ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল খোলার উদ্যোগ অন্যতম। এসব উদ্যোগের ফলে পণ্য আমদানিকারকদের মধ্যে স্বস্তির আভাস মিলছে। কিন্তু রমজানের আগে এসব পণ্য দেশে এসে বাজার ধরতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

বিদেশি সরবরাহকারীর সঙ্গে সমঝোতা করা, আমদানির অনুমতি নেওয়া, ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা, পণ্য জাহাজীকরণ এবং সেই পণ্য দেশে পৌঁছে পাইকারি বাজারে সরবরাহ দেওয়া অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন কিছু ব্যবসায়ী। কারণ ১৫ ডিসেম্বর থেকেই যদি ঋণপত্র খোলা হয় তাহলে রমজানের আগে তিন মাস সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু পাইকারি বাজারে রমজানের ভোগ্য পণ্য বিক্রি শুরু হয় শবেবরাতের আগে অর্থাৎ ১৫ দিন আগে। সে হিসাবে আমদানিকারকদের হাতে সময় থাকে আড়াই মাস। এরপর তদারকি থাকলে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব বলে মত ভোগ্য পণ্য ব্যবসায়ীদের।

ভোগ্য পণ্য আমদানিতে অভিজ্ঞ এটিআর ট্রেডিংয়ের প্রধান নির্বাহী নুরুল আলম বলেন, ‘এ সপ্তাহেও যদি সরকারের সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করে, তাহলে আমরা রমজানের আগে ভোগ্য পণ্য আমদানি করে দেশের পাইকারি বাজারে পৌঁছাতে পারব। কিন্তু এক সপ্তাহ দেরি হলেই জটিলতা তৈরি হবে।’

উদাহরণ দিয়ে নুরুল আলম বলেন, ‘তানজানিয়া থেকে পাঁচ কনটেইনার ছোলা আমদানির জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার আবেদন গত সপ্তাহেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তখনই অনুমোদন পেলে দ্রুত দেশে আনতে পারতাম। আর রমজানে প্রচুর ময়দাজাতীয় পণ্য লাগে, সে জন্য এক লাখ ডলারের গম আমদানির ঋণপত্র খোলাও আটকে আছে। এগুলো এখই না ছাড়লে রমজানে ঝুঁকি বাড়বে।’

ডলার সংকট কাটেনি : ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়, বড় শিল্প গ্রুপগুলো ঋণপত্র খোলার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে তাদের কেনা ভোগ্য পণ্য যথাসময়েই চলে আসছে দেশে। ছোট ও মাঝারি আমদানিকারকরা এখন সুযোগ পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

মাঝারি মানের এক নিয়মিত ভোগ্য পণ্য আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘১০ কনটেইনার খেজুর আনার জন্য বিদেশি সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন। বেসরকারি ব্যাংকে আমার লিমিটও আছে। কিন্তু আমার আবেদন ঝুলে আছে। ’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সুফল সব ব্যবসায়ী না পেলে বাজার অল্প কয়েকজনের হাতে চলে যাবে। তাতে ঝুঁকি বাড়বে।

আড়াই মাসে পণ্য দেশে পৌঁছবে? : রমজানের বেশির ভাগ পণ্য আড়াই মাসে দেশে পৌঁছানো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন দুবাইভিত্তিক ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান অসীম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার অসীম কুমার দাশ। তিনি বলেন, নভেম্বর থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারলে আমদানিকারকরা সবাই খোঁজখবর নিয়ে পণ্য আমদানির সুযোগ পেতেন। যেমন—ছোলা অস্ট্রেলিয়া থেকে আনতে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন।

অসীম কুমার দাশ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রমজানের ভোগ্য পণ্যের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু দেশে ঋণপত্র খোলা ও ডলার সংকট—সব মিলিয়ে পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। এর পরও সিদ্ধান্তগুলো তদারকি করা গেলে সুফল মিলবে। বাজার ধরতে গেলে এসব পণ্য কিন্তু শবেবরাতের আগেই দেশে পৌঁছাতে হবে। ফলে সময়টা একেবারে কানায় কানায়।

রমজানের পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ : রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি, খেজুরসহ আট পণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ। ডলার সংকটের কারণে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এসব ভোগ্য পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লাইয়ার্স ও বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ প্রদান করা হচ্ছে। এই সুবিধা ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রযোজ্য থাকবে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রমজানের পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। কিন্তু ব্যাংককে ইতিবাচক ভূমিকায় থাকতে হবে। কারণ ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপরই ঋণপত্র খোলা, বাকিতে পণ্য আমদানির সুফল নির্ভর করছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে তদারকের ভূমিকায় থাকতে হবে, যাতে একটি দিনও ঋণপত্র খুলতে নষ্ট না হয়।

রমজানে কত পণ্যের প্রয়োজন : গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিকারক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের এক সভায় আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি তুলে ধরেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ।

সেখানে বলা হয়েছে, চলতি ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি ও গম আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এই পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রয়োজন।

এর মধ্যে ৮১২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২২.১৯ লাখ টন গম, ৯৭৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সাত লাখ টন ভোজ্য তেল এবং আট লাখ টন চিনি আমদানিতে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। এ ছাড়া ছোলা আমদানিতে ১৩৪.৪৯ মিলিয়ন ডলার, খেজুর আমদানিতে ৫২.৬৭ মিলিয়ন ডলার এবং মসুর ডাল আমদানিতে ১৪০.৬৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।