হুন্ডিকে ‘না’ বলার সময় এসেছে

বর্তমান বাংলাদেশের রিজার্ভসংকট সমস্যার পেছনে বিদেশে টাকা পাচারই একমাত্র কারণ নয়, হুন্ডি ব্যবসাও এই সংকটের উল্লেখযোগ্য কারণ। হুন্ডি হলো নন-ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ বাংলাদেশে আনা। হুন্ডি বলতে বোঝায়, একটি দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। এটি নীতিবহির্ভূত ও দেশের আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। এর মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে অর্থের অবৈধ লেনদেন হয়। এটি বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ করে না, যার ফলে কোনো একটি রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ হুন্ডি বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়। মনে করি ‘ক’ নামের এক ব্যক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মাস শেষে তার পরিবারকে টাকা পাঠাতে হবে। তিনি একটি ব্যাংকে গিয়ে বাংলাদেশে ১ লাখ টাকা পাঠাতে চাইলে, সেখানে দেখলেন ব্যাংকে অতিরিক্ত ১৫ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে। তিনি তখন ব্যাংক থেকে ফিরে এসে ‘ঙ’ নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। ‘ক’ ব্যক্তি তার মাধ্যমে টাকা পাঠাতে চাইলে অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে বা কখনো কখনো ‘ঙ’ ব্যক্তি ‘ক’ ব্যক্তিকে অতিরিক্ত কিছু অর্থ প্রদান করে দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মূলত ‘ঙ’ ব্যক্তি ‘ক’ ব্যক্তির কাছ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে বসে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং বাংলাদেশে থাকা তার প্রতিনিধিকে ‘ক’ ব্যক্তির পরিবারের কাছে অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকেন। এই অর্থ লেনদেন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং পদ্ধতির চেয়ে সহজ ও কখনো কখনো দ্রুত সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে।

হুন্ডির প্রচলন মূলত শুরু হয় মোগল শাসনামলে। বৃহৎ পরিমাণে অর্থ লেনদেনের জন্য হুন্ডি প্রধান মাধ্যম ছিল। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা পাঠানো অসম্ভব ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দূরবর্তী স্থানে বাণিজ্যের জন্য হুন্ডি ছিল খুবই নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ পদ্ধতি। সতেরো শতকে বাংলা থেকে দিল্লিতে ভূমি হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হতো। এছাড়া বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন ছিল হুন্ডি ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আঠারো শতকের মধ্যে ইউরোপের উপকূলবর্তী প্রায় সব দেশের বণিকরা বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসেন। স্থানীয় বণিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পর হুন্ডি ব্যবস্থা তাদের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে। তৎকালীন সময়ে জগৎ শেঠ সর্ববৃহৎ হুন্ডি ব্যবসায়ী ছিলেন। ইংরেজদের কাছে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেওয়ার জন্য রানির সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।

হুন্ডি (Hundi) মূলত ব্যাংকিং নিয়ম অনুসরণ করে না বলে বৈধ উপার্জন অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। একটি দেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ২২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রবেশ করায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে।

হুন্ডি একটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতিসাধন করে থাকে। এর মাধ্যমে খুব সহজেই দেশ থেকে অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। প্রবাসীদের আয় ব্যাংকিং নিয়ম অনুসারে দেশে প্রবেশ তা বাংলাদেশের রিজার্ভে জমা হয়, যার ফলে দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি সাধিত হয়। হুন্ডির ফলে বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে চলে যায়, সেটি আর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে না। এছাড়া হুন্ডির ফলে প্রবাসীরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের পাঠানো অর্থপ্রাপ্তির বিষয় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।

হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যামাউন্ট নেই। এছাড়া এর মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর জন্য লিগ্যাল কোনো ডকুমেন্টস লাগে না। তারপরও হুন্ডি ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক দুর্যোগের অন্য একটি নাম। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার হুন্ডি প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রবাসীদের উপার্জিত আয় যেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের সচেতনতা, প্রণোদনা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। এছাড়া প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোয় প্রবাসীদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানি বন্ধ করে রেমিট্যান্সের গতি বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট মহলকে কাজ করতে হবে।

লেখক : মো. মিফতাহুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়