আখের দামে খুশি কৃষক, ফিরছেন চাষে

প্রতি মাড়াই মৌসুমে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের ধারণক্ষমতা দেড় লাখ টন আখ এবং উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার মেট্রিক টন চিনি। চার বছর ধরে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের পরিমাণ ওঠানামা করছে। তবে কোনো লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ না হওয়ায় প্রতিবছর লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি।

গত ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে বাংলাদেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। সেই সময় এই চিনিকলটি বন্ধের শঙ্কায় আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কৃষকরা। ফলে ২০২১ সালে আখ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) আবু রায়হান বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা কৃষকদের আখ চাষে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আখের দাম বাড়ায় কিছুটা অগ্রসরও হওয়া গেছে। এ মৌসুম থেকেই চিনিকলে সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুম শুরু হচ্ছে চলতি মাসেই। গত বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণ আখ চাষ করেছেন আখ চাষিরা। নতুন করে অনেকেই আখ চাষে ঝুঁকেছেন।

ঠাকুরগাঁও চিনি কলের দেয়া তথ্যমতে, চিনিকলে ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে জেলার চাষিদের ৬১ হাজার ৭৬০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয়েছিল। কিন্তু আগে থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, চিনিকল বন্ধ হবে। ফলে ২০১৯-২০ মৌসুমে আখের মাড়াই কমে দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ৮৭৯ টনে। ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও সেতাবগঞ্জ তিন মিলের আখ মাড়াই হয় ঠাকুরগাঁও চিনিকলে। এই মৌসুমে চিনিকলে আখ মাড়াই হয় ১ লাখ ১৩ টন। এই মাড়াই মৌসুমে জেলার ৫০ হাজার টন আখ মাড়াই হয়েছিল চিনিকলে। এরপর সর্বশেষ ২০২১-২০২২ মাড়াই মৌসুমে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওয়ের ৫৭ হাজার ৮৩৪ টন আখ মাড়াই হয়। এই বছরে জেলার আখচাষিরা উৎপাদন করেছিলেন ৩৬ হাজার টন আখ। তবে চলতি বছর মাড়াই মৌসুমে কেবল ঠাকুরগাঁওয়ের আখ মাড়াই হবে চিনিকলটিতে।

এবার জেলায় আখের চাষ বেড়েছে দাবি করে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক আবু রায়হান বলেন, ‘নানা সমস্যার কারণে জেলার কৃষকরা আখ চাষে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সরকারের নির্ধারিত দামে খুশি হয়ে আখ চাষে ফিরতে শুরু করেছেন তারা। গত বছর দুই জেলা মিলে যা উৎপাদন হয়েছিল, এবার ঠাকুরগাঁওয়ে তার দ্বিগুণ আখ চাষ হয়েছে। গত বছর মাড়াই মৌসুমে জেলার ৩৬ হাজার টন আখ মাড়াই হয়েছিল। এবার ৬০ হাজার টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছি আমরা।’

চিনিকলের হিসাব শাখার সূত্রে জানা যায়, গত বছর মাড়াই মৌসুমে ৫৭ হাজার টন আখ মাড়াই করে ২ হাজার ৯২২ টন চিনি উৎপাদন করা হয়েছে। অথচ এই চিনিকলের উৎপাদনক্ষমতা এখনো ১০ হাজার টন। কেবল আখের উৎপাদন স্বল্পতার কারণে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না চিনিকলের।

কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে এ পরিস্থিতিতে ইতিবাচক সাড়া মিলছে জানিয়ে চিনিকল কর্মকর্তা আবু রায়হান বলেন, ‘চিনিকলের নিজস্ব জমি রয়েছে ৭২৭ হেক্টর। এ ছাড়া বর্তমানে জেলার প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে আখ উৎপাদন করছেন ৩ হাজার কৃষক। মোট ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আখ চাষ হলেই সুদিন ফিরবে চিনিকলটির। আগামী বছর আখচাষি আরও বাড়বে বলেও মনে করছেন এই কর্মকর্তা।

আবু বায়হান আরও বরেন, ‘আখচাষিদের সরকারের দেয়া সুযোগসুবিধা, আখের দাম প্রতি কুইন্টালে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৪৫০ টাকা করাসহ নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।’

বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ে চলছে আখ রোপণের সময়। মাঠে ঘুরে দেখা গেছে, আখ রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সদর উপজেলার আকচা গ্রামের কৃষক হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে আখ উৎপাদন করে আগে তেমন দাম পাওয়া যেত না। এখন সরকার যে দাম দিচ্ছে, আমি মনে করি আখই একমাত্র লাভজনক ফসল। প্রতি বিঘাতে বছরে ৫০-৬০ হাজার টাকা লাভ থাকতে পারে।’

আখ চাষ বাড়ানোর মাধ্যমে চিনিকলে সুদিন ফেরার আশা করছেন স্থানীয়রাও। ২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প বাঁচাতে সাত দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল জেলাবাসী। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- ঠাকুরগাঁও চিনিকল লাভজনক করতে আধুনিকায়ন ও ডিস্টিলারি ইউনিট স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন, সুগার বিট প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটির টাকা পরিশোধ, আখচাষিদের টাকা সময়মতো পরিশোধসহ সারা বছর চিনিকল চালু রাখতে সেগুলোকে সুগার আমদানির অনুমতি দিয়ে পরিশোধন কারখানা স্থাপন।

আন্দোলনের আহ্বায়ক মাহাবুব আলম রুবেল বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিনির দাম বাড়তি। আখের উৎপাদন বাড়িয়ে চিনিকলগুলো বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে আমাদের পুরোপুরিভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়তে হবে। জেলাতে আখের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। আশা করি চিনিকলটির সুদিন ফিরবে।’

ঠাকুরগাঁও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাহান কবির বলেন, ‘আমরা কৃষকদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, আখ উৎপাদন করে তারা লাভবান হতে পারবেন। আমরা কৃষকদের সার-কীটনাশকের জোগান দিয়ে সহযোগিতা করছি। কৃষকরা আখ চাষে ঝুঁকছেন। আমরা চিনিকলটির সুদিনের সম্ভাবনা দেখছি।’