বহুমুখী ভূমিকায় থানা পুলিশ, জন্ম থেকে মৃত্যু সব কাজেই তারা

ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা, অপরাধ বা আনন্দ উৎসব- সব কাজে সবখানেই যেন থানা পুলিশ। ঘটনা ছোট-বড় যা-ই হোক, সেখানে থানা পুলিশকে কাজে লাগবেই। এ ছাড়া চুুরি, ছিনতাই-ডাকাতি, খুন-জখম, রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড ও বিশৃঙ্খলাসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণেও প্রধান ভূমিকা পালন করছে থানা পুলিশ। বলা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু- সব কাজেই থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা দৃশ্যমান। অর্থাৎ বহুমুখী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় থানায় নিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের। এমন ভূমিকায় সাধারণত পুলিশের অন্য ইউনিটগুলোকে সেভাবে দেখা যায় না। কেননা বিশেষায়িত ইউনিটগুলো মূলত তাদের বিশেষ দায়িত্বগুলোই পালন করে থাকে।

সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি থানায় গিয়ে সরেজমিন তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে এমনই চিত্র দেখা যায়। আলাপকালে থানা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, থানার একজন পুলিশ সদস্যের নির্ধারিত কোনো দায়িত্ব নেই। স্থান-কাল-পাত্রভেদে নানা দায়িত্বের ভার চাপে তাদের কাঁধে।

থানা পুলিশের নির্ধারিত কাজ বলে কিছু নেই। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুসারে তাদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো কিছু অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত থানা পুলিশের বহুমুখী ভূমিকার কারণেই নগরবাসী নিরাপদে-স্বস্তিতে বসবাস করতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন কর্মকর্তারা। সাধারণ ডায়েরি (জিডি), মামলা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে টহল-মনিটরিং, সামাজিক অপরাধ রোধে নানা কার্যক্রম, কলহ-বিবাদ নিয়ে সালিশ-দরবার, নিরাপত্তা টহল (প্যাট্রোল ডিউটি), রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক নানা অনুষ্ঠান-কর্মসূচির নিরাপত্তা, প্রটোকল, যানজট নিরসন থেকে শুরু করে বলতে গেলে এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থানা পুলিশের ভূমিকা নেই। তবে বর্তমানে মামলা-জিডির তদন্ত ও এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার বাইরেও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড সামলানো।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘থানা পুলিশের একজন সদস্যকে নানা পরিস্থিতিতে ডিউটি করতে হয়। থানা পুলিশের কাজের কোনো শেষ নেই। পুলিশ বাহিনীর সার্বিক মর্যাদা ও সুনামও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থানা পুলিশের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে। কারণ থানা পুলিশ সরাসরি জনগণের প্রয়োজনীয় আইনি সেবায় প্রথম ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই থানায় পুলিশের সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। থানায় গিয়ে কোনো নাগরিক যেন অসম্মান বা দুর্ব্যবহারের শিকার না হন, সে লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে বর্তমানে থানায় পুলিশি সেবার মান অনেক বেড়েছে বলে মনে করি। এ ছাড়া ভালো সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে থানা পুলিশের জন্যও আরও কিছু সুবিধা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে, সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।’

সরেজমিন দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বনানী মডেল থানা ভবন অভিমুখে ‘সাদাছড়ি’ হাতে হাঁটছিলেন এক তরুণ। এ সময় বাইরে দাঁড়ানো পুলিশ কনস্টেবল মাসুদ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওই যুবকের হাতটি ধরে থানা ভবনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকেন। তখন প্রতিবেদক এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ওই তরুণ জানান, তার নাম শাহিনুর ইসলাম জয়। বনানীতে ‘লুকাস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেন। প্রতিষ্ঠানের একটি কাজে তিনি থানায় যাচ্ছিলেন। এ সময় ওই পুলিশ কনস্টেবল মাসুদ বলেন, ‘ওই তরুণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী (অন্ধ) হলেও তিনি শিক্ষিত এবং তার কিছু বিশেষ প্রতিভা আছে। আমরা মাঝেমধ্যেই দেখি তিনি এলাকায় একাকী সাদাছড়ির সাহায্যে চলাচল করেন। থানায় আসছেন দেখে এগিয়ে নিতে গিয়েছিলাম।’

বনানী থানায় ঘণ্টাখানেক অবস্থানকালে থানা ভবনে প্রবেশ করতে বামপাশে নারী ও শিশু হেল্প ডেস্কে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা (এসআই) বসে সেবাপ্রার্থী অপর একজন নারীকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। বোরকা পরিহিত ওই সেবাপ্রার্থী নারীকে চা পান করতেও দেওয়া হয়। একইভাবে থানায় প্রবেশের ডানদিকে কক্ষে ডিউটি অফিসারের সামনেও চেয়ারে বসে জিডি করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন এক ব্যক্তি।

এ সময় বনানী মডেল থানার ওসি নূরে আজম মিয়ার কক্ষে গিয়ে ওইসব প্রসঙ্গে আলাপ হয়। ওসি নূরে আজম বলেন, ‘বলতে গেলে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কাজেই থানা পুলিশকে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা পালন করতে হয়। থানা পুলিশের নির্দিষ্ট ডিউটি বলতে কিছু নেই। তবে কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের “ডিউটি আওয়ার” রয়েছে।’

বনানী থানা সূত্রে জানা যায়, ডিএমপি মডেল থানা হিসেবে সর্বমোট ১৯৪ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে বনানী থানার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। তার মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) তিনজন। তারা হলেন- অফিসার ইনচার্জ (ওসি), পরিদর্শক (তদন্ত) ও পরিদর্শক (অপারেশন)। এ ছাড়া উপ-পরিদর্শক (এসআই, নিরস্ত্র) ৪১ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই, নিরস্ত্র) ২৮ জন, কনস্টেবল ৫১ জন, আনসার ৫২ জন, গাড়িচালক ১৪ জন, বেতার অপারেটর তিনজন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী একজন এবং বাবুর্চি একজন।

এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে রামপুরা থানায় গিয়ে দেখা যায়, কনস্টেবল নজরুল থানার গেটে ডিউটি করছেন। দায়িত্বরত ডিউটি অফিসার তৌফিক এ সময় দাফতরিক কাজ করছিলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই একজন ব্যক্তি থানা থেকে বের হচ্ছিলেন। কথা বলতে গেলে তিনি তার নাম সজিব বলে জানান। তিনি বলেন, জমির খাজনার কাগজ হারিয়ে যাওয়ায় থানায় জিডি করতে এসেছিলেন। কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই তিনি জিডি করেছেন। পুলিশও আন্তরিক ছিল।

ডিউটি অফিসার তৌফিক বলেন, ‘থানায় বর্তমানে জিডি হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০টি জিডি হয় এ থানায়।’

এরপর সরেজমিন মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন সড়কের মুখে একটি পুলিশ ভ্যানের পাশে তিনজন কনস্টেবলসহ রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিলনকে সড়কের শৃঙ্খলা ও যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে দেখা যায়। এ সময় জানতে চাইলে এসআই মিলন বলেন, ‘থানা পুলিশের যখন যে ডিউটি পড়ে সেটি করতে হয়। রাতে টহল দেওয়া, মামলার তদন্ত করা, সচেতনতামূলক বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।’

রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক মিন্টু বলেন, এ থানায় তিনজন পুলিশ পরিদর্শক (ওসিসহ), ৩৫ জন এসআই, ৩২ জন এএসআই এবং ৫৬ জন কনস্টেবলসহ সর্বমোট ১৪৮ জন পুলিশ সদস্য কর্মরত।

ডিএমপি সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা শহরে ডিএমপির অধীনে বর্তমানে ৫০টি থানার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। থানাসহ ডিএমপির সব ইউনিট মিলে সর্বমোট ২৬ হাজার ৬৬১ জন পুলিশ সদস্য কর্মরত। এর বাইরেও রিজার্ভ ফোর্সও রয়েছে।