৫০ বছরে ৪৪৯ বিদেশিকে নাগরিকত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪৪৯ বিদেশিকে নাগরিকত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে ২৯ দেশের নাগরিককে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতের। ১৯৮৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ভারতের ১৬৬, পাকিস্তানের ২৬, ফিলিপাইনের ১৫, শ্রীলঙ্কার ১৪, ইরানের ৮, রাশিয়ার ৭, হংকংয়ের ৭ ও থাইল্যান্ডের ৬ জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৬ বাংলাদেশি নাগরিক তাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

সুরক্ষা সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়া-ফিলিস্তিনের ৩, যুক্তরাজ্যের ৪ এবং মিয়ানমার, জর্ডান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ২ জন করে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ইরাক, তুরস্ক, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, ফ্রান্স, নেপাল, সুইজারল্যান্ড, ওমান ও ইন্দোনেশিয়ার একজন করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন।

নাগরিকত্ব পাওয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন একাত্তরে পাকিস্তানিদের আক্রমণে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সহায়তার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হয়ে ওঠা ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিস। তিনি ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান। ১৯৬৮ সাল থেকে বিহারে অক্সফামের একটি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতেন ফ্রান্সিস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিদের জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় জুলিয়ান ফ্রান্সিস এ দেশে ১৯৯৮ সাল থেকে বাস করছেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশপ্রেমী ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত বছরের ১৫ মার্চ নাইজেরীয় স্ট্রাইকার এলিটা কিংসলেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের মেয়ে বিয়ে করায় নাইজেরীয় স্ট্রাইকার এলিটা বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার আবেদন করেছিলেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (বহিরাগমন শাখা-৩) আলীমুন রাজিব জানান, ২০২২ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ৯, ২০২১ সালে ৩, ২০২০ সালে ৪, ২০১৯ সালে ৬, ২০১৮ সালে ৮, ২০১৭ সালে ৯ ও ২০১৬ সালে ২ জন বিদেশিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ৩, ২০১৪ সালে ৮, ২০১৩ সালে ৬, ২০১২ সালে ২২ ও ২০১১ সালে ৩ জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন ৯ বিদেশি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ২০১৬-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। আইনের খসড়ায় বিতর্কিত কয়েকটি ধারা ও উপধারায় সংশোধনী আনতে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ। কিন্তু সাড়ে ৬ বছরেও শেষ হয়নি ভেটিংয়ের (যাচাই) কাজ। ভেটিং দ্রুত শেষ করার জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগকে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে তাগিদ দেওয়া হলেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ আইন চূড়ান্ত অনুমোদন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ফলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া এবং নাগরিকত্ব বাতিলসহ এ ধরনের বিষয়গুলো ‘দ্য সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫১’ এবং ‘দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ টেম্পোরারি প্রভিশন্স অর্ডার, ১৯৭২’-এর আলোকে চলছে। দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ টেম্পোরারি প্রভিশন্স অর্ডার, ১৯৭২-এ বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকারের কাছে সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করলে নির্ধারিত শর্তে যে কোনো ব্যক্তিকে স্থায়ী বসবাসের অধিকার দিতে পারে। এ আইনের আলোকে সরকার সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকদের আবেদন যাচাইবাছাই করে নাগরিকত্ব দেয়।

অন্যদিকে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৬ বাংলাদেশি নাগরিক তাদের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। সুরক্ষা সেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন তারা। ২০১৭ সালে ১৬৭, ২০১৮ সালে ৪৫৮, ২০১৯ সালে ৩০৮, ২০২০ সালে ২৩৭, ২০২১ সালে ২৬২ এবং ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬৪ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন।

সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশি পাসপোর্ট জমা দিয়ে তারা নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন করার পর মন্ত্রণালয় তা মঞ্জুর করে। গত ৭ বছরে ১৯টি দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন এসেছিল। অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে চান, তাহলে তাকে নির্ধারিত ফরমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পাশাপাশি নির্ধারিত ফি জমা দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এটি যাচাইবাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রত্যয়ন দেওয়া হয় যে, আবেদনকারীর নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন সরকার গ্রহণ করেছে। তবে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে যখন কোনো ব্যক্তি জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো কোনো দেশের নাগরিক হতে চান। ওই দেশ তিনটিতে নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত হিসেবে নিজ দেশের নাগরিকত্ব বর্জন করতে হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ভারতসহ সার্কভুক্ত কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিতে চাইলেও নিজ দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ বা বর্জন করতে চান, তাহলে প্রথমেই তাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হবে। তবে ব্যক্তি যদি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন, তাহলে যেকোনো সময় নিজের পাসপোর্ট পুনরায় ‘ক্লেইম-ব্যাক’ বা ফিরে পাওয়ার আবেদন করতে পারবেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী জানান, নাগরিকত্ব আইন, ২০১৬ ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ রয়েছে। যেহেতু নতুন আইনটি এখনও পাস হয়নি সে জন্য বিদ্যমান আইন ও বিধি মেনেই বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন এবং তা যাচাইবাছাইয়ের পর নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশের কেউ নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে চাইলে তারা আবেদন করেন। আইন অনুযায়ী সবকিছু ঠিক থাকলে আবেদন মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবেদনকারীর বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল করে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদফতরকে অবহিত করে অনুলিপি দেওয়া হয়। আর আবেদনকারী বিদেশে অবস্থান করলে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসকে এ তথ্য অবহিত করা হয়।