দিনাজপুরে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প

ভবিষ্যতের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের কৃষকদের পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পটি আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (্একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। একনেক সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি অনুমোদন দিতে পারেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নকাল ৫ বছর ধরা হয়েছে। ৬৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি ২০২৭ সালের জুন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)।

এই প্রকল্পের বিষয়ে ডিএই বলছে, দিনাজপুর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সমভূমির উঁচু ও মাঝারি উঁচু অঞ্চলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ, নতুন ফসল অন্তর্ভুক্তকরণ, উচ্চমূল্যের ফসল চাষসহ জলবায়ুর ঝুঁকি এড়াতে সক্ষম লাগসই কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে শস্যের নিবিড়তা বাড়ানোর পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও শিল্পায়নের প্রভাবে এ অঞ্চলে কৃষি পরিবেশ ক্রমেই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে আর্থ-সামাজিক কারণে ক্রমান্বয়ে ধনী কৃষকরা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় কৃষি চলে যাচ্ছে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির হাতে। এতে মূলধনের অভাবে ফসলের ভালো ফলনের প্রয়োজনীয় উপাদান সঠিক সময়ে সরবরাহ করতে না পারায় ফলন কম হচ্ছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের শিক্ষিত নারী, তরুণ ও যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে পুষ্টিকর উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন ও বিপণনের অঞ্চলভিত্তিক সম্ভাবনা, সুযোগ এবং সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে অবদান রাখার তাগিদ থেকে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে শস্যের নিবিড়তা ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় উচ্চমূল্য ফসলের উৎপাদন ১২ শতাংশ বৃদ্ধি এবং জমির উৎপাদনশীলতা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা, মাটির স্বাস্থ্য সংক্ষণসহ ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উচ্চমূল্য ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ১০ শতাংশ হ্রাস করা এবং খোরপোষ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে এক হাজার ৪৪০ জন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করা।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি প্রদর্শনীর আওতায় তিন হাজার ৬০টি দানাদার ফসল, ৯ হাজার ৭৯২টি উচ্চমূল্যের নিরাপদ সবজি, এক হাজার ৮৩৬টি তেল জাতীয় ফসল, তিন হাজার ৬০টি একক ফল বাগান, এক হাজার ২২৪টি মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ প্রযুক্তি, দুই হাজার ৩৮০টি বিশেষ প্রযুক্তি প্রদর্শনী, ৫টি কৃষক কেন্দ্র নির্মাণ, ১১৫টি বিদ্যুৎবিহীন কুলিং চেম্বার নির্মাণ, ৮টি পলিনেট/শেড হাউস ৯২টি উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, দুই হাজার ১৩৫টি মাঠ দিবস, ১২টি কৃষি প্রযুক্তি মেলা এবং অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে এক হাজার ৮৩৬ ব্যাচ কৃষক, ৬৪ ব্যাচ উদ্যোক্তা ৪৪ ব্যাচ এসএএও, ১০ ব্যাচ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ।

প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বিভাজন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রশাসনিক ব্যয় বাবদ ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা যা মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় হবে ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা মোট ব্যয়ের ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ, প্রযুক্তি প্রদর্শনী বাবদ ব্যয় হবে ২৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা যা মোট ব্যয়ের ৪২ শতাংশ, বিদ্যুৎবিহীন কুলিং চেম্বার ও অন্যান্য নির্মাণ বাবদ ব্যয় হবে চার কোটি ৪০ লাখ টাকা মোট ব্যয়ের ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, মাঠ দিবস খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।

প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতার বিষয়ে ডিএই বলছে, কৃষি বৈচিত্র্য বিবেচনায় দিনাজপুর অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় কৃষি অঞ্চল। এ অঞ্চলের কৃষি প্রকৃতি, কৃষি বৈচিত্র্য, কৃষি পরিবেশ ও সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক প্রকল্প এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে।

প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা সূত্রে জানা গেছে, পিইসি সভায় কৃষি প্রযুক্তি মেলা, মাঠ দিবস ও বিশেষ প্রযুক্তি প্রদর্শনীর সংখ্যা যুক্তিসংগত ভাবে নির্ধারণ করা হয়। প্রচার ও বিজ্ঞাপন এবং অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ খাতে প্রস্তাবিত ব্যয় যৌক্তিকভাবে হ্রাস এবং আউটসোর্সিং জনবল সেবা, কোভিড-১৯ নিরাপত্তা সামগ্রী, কনসালটিং ফার্ম, প্রগ্রেস মনিটরিং, উদ্যোক্তা পর্যায়ে উপকরণ সহায়তা, ডাটাবেজ, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ/শিক্ষা সফর ইত্যাদি খাতের ব্যয় ডিপিপি হতে বাদ দেওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্তকরণে সুপারিশ করা হয়। পিইসি সভার সুপারিশের আলোকে প্রকল্প ব্যয় ৬৯ কোটি ৪৯ লাখ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে প্রকল্প হ্রাসপূর্বক ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়েছে। পিইসি সভার সিদ্ধান্ত এবং কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাদি সংযোজনী ‘খ’-তে উপস্থাপন করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অনুদানে মোট ৬৫ কোটি ৩১ লাখ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০২২ হতে জুন ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উত্থাপন করা হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দিনাজপুর অঞ্চলে উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন, শস্য উৎপাদনে বিচিত্রতা আনয়ন, নিরাপদ ফসল উৎপাদন, কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, নারী ও তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি, কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং জাতীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণে আধুনিক প্রযুক্তি ও কার্যক্রম সম্প্রসারণে প্রকল্পটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।