দেশে চলমান সংকটেও বেড়েছে বিদেশি বিনিয়োগ

চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দেশে বাড়ল বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১১৬ কোটি (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই তিন মাসে ৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।

তবে এই সংকটকালে এটিও কত দিন বজায় থাকবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, দীর্ঘদিন দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করায় বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই রাজধানীতে মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হয়ে যাবে। এসবের ইতিবাচক প্রভাবও বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছিল। সে কারণে গত অর্থবছরে বেশ ভালো এফডিআই এসেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছিল। কিন্তু এই কঠিন সময়ে সেটা কেমন আসবে-সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। এই তিন মাসে ৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ৩৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ (৪.৭১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছিল আরও বেশি, ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই এসেছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

আড়াই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতি নিয়ে যখন নানা হতাশা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল, তখন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে আগামী দিনগুলোতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা। বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়। গত ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। এই সেতু ঘিরে কয়েক মাস ধরে দেশে বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছিল। সে কারণেই শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি, পরিবহন খাতের বাস-ট্রাক তৈরির যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতের সব ধরনের যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামের আমদানি বেশ বাড়ছিল। সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।

কিন্তু সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানির লাগাম টেনে ধরতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এখন আমদানি ব্যয় বেশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছিল ৪১ শতাংশের মতো। কিন্তু চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ৬৬ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ১৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি কমেছে ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি গত আগস্টে বেড়ে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল। যা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরে তা কমে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৭ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ শতাংশের মতো বিনিয়োগ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৮ শতাংশ।

এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, চীন, মিসর, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ এই পাঁচ অর্থবছরে দেশে মোট ২৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।