লাল কাঁকড়ার নকশি কাঁথা

ভাটার পর সৈকতের গর্ত থেকে উঠে আসে লাল কাঁকড়াগুলো। এরপর চিকচিক করা বালিয়াড়িতে শুরু হয় তাদের ছোটাছুটি। তখন তাদের পায়ে তৈরি হয় নানা আকৃতির আলপনা। ধূসর বালুর জমিনে এ যেন নকশি কাঁথা।

পর্যটকরা লাল কাঁকড়ার পাশাপাশি এদের আলপনা দেখে মুগ্ধ হয় ‘ইমামের ডেইল’ সৈকতে।

কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে ৪৫ কিলোমিটার দূরে দৃষ্টিনন্দন এই সৈকত। মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইমামের ডেইল (বাইলাখালী) এলাকায় এর অবস্থান। এলাকাটি ‘লাল কাঁকড়া সৈকত’ নামেও পরিচিতি পেয়েছে।

পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, একসময় লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ ছিল কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। কিন্তু পর্যটকদের অতিরিক্ত আনাগোনায় কয়েক দশক আগেই সৈকতের সেই আকর্ষণ হারিয়ে গেছে। এবার সেই লাল কাঁকড়া ফিরে এসেছে উখিয়ার ইনানির পাথুরে সৈকতের দক্ষিণে ইমামের ডেইল নামের বালুচর সৈকতে।

স্থানীয় লোকজন জানায়, সৈকতের অন্য স্থানের চেয়ে ইমামের ডেইল এলাকা কিছুটা কোলাহলমুক্ত। এ কারণে মেরিন ড্রাইভের পশ্চিম পাশে সাগরতীরের ঝাউগাছবেষ্টিত এলাকায় এখন লাল কাঁকড়া দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর জানান, লাল কাঁকড়া (ঘোস্ট কাঁকড়া বা ভূত কাঁকড়া) সৈকতের জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী এলাকায় বাস করে। এসব প্রাণী পৃথিবীর ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় গভীর গর্তে বাস করে। এরা নিশাচর, কিন্তু দিনের আলোতেও স্বাচ্ছন্দ্যে বালুময় সৈকতে বিচরণ করে। তাই এদের বালুর কাঁকড়াও বলা হয়।

সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ আরো জানান, লাল কাঁকড়া বা রেড ঘোস্ট ক্র্যাবের বৈজ্ঞানিক নাম Ocypode Macrocera। এ পর্যন্ত বিশ্বে সন্ধান পাওয়া ছয় হাজার ৭৯৩ প্রজাতির কাঁকড়ার অন্যতম এটি।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সৈকতে এ কাঁকড়ার আধিক্যের কারণ হলো এটি তাদের প্রজননকাল। এ সময়ে প্রচুর লাল কাঁকড়া সমুদ্রের বালিয়াড়িতে গভীর গর্ত করে বসবাস করে। ’

জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহাবুদ্দিন জানান, লাল কাঁকড়া সৈকত হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এলাকাটি তাঁর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। এটি পর্যটকদের জন্য এখন আকর্ষণীয় সৈকত হয়ে উঠেছে।

ইউপি সদস্য শাহাবুদ্দিন জানান, লাল কাঁকড়ার প্রজননের সুবিধার্থে এলাকাটি সংরক্ষণ করার জন্য জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাঁশের ঘের দিয়ে সংরক্ষণও করেছিলেন। কিন্তু পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের আপত্তিতে উপজেলা প্রশাসন সেই ঘের সপ্তাহ দুয়েক আগে তুলে নিয়েছে। এতে লাল কাঁকড়ার সৈকতটি এখন অরক্ষিত।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি পরিবেশ আন্দোলনকর্মী আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সৈকতের পরিবেশ-প্রতিবেশ ঠিক রেখে লাল কাঁকড়া সংরক্ষণের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। ইমামের ডেইল কাঁকড়া সৈকত নিঃসন্দেহে পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ দেবে। ’

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজিব বলেন, ‘কক্সবাজার সৈকতে লাল কাঁকড়ার এমন অপরূপ দৃশ্য অন্য কোথাও নেই। তাই ঝাউবীথি ও বালুর ঢিবিতে লাল কাঁকড়ার নিরাপদ বসবাসের সুবিধার্থে বাঁশ ও কাঠের অস্থায়ী সীমানাপ্রাচীর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল সৈকতটি। এতে সেখানে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল লাল কাঁকড়ার সংখ্যা। ’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, তাঁর পরিবেশ সংরক্ষণের পদক্ষেপে ‘পরিবেশ ধ্বংসের’ অভিযোগ এনে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন আইনি নোটিশ দিয়েছে। এ কারণে তিনি সম্প্রতি বাঁশের ঘের তুলে নিয়েছেন।

এ বিষয়ে সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, ‘আমি সম্প্রতি মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন লাল কাঁকড়া সৈকত পরিদর্শন করে এসেছি। সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত লাল কাঁকড়া সংরক্ষণের উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল। ’