একসময় দেশে শরীর-মন চাঙ্গা করার পানীয় হিসেবে চা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে কফির ভোগ বেড়েছে। কালের প্রবাহে আজ শহুরে উচ্চবিত্ত মহলের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত সমাজ তথা মফস্বল এমনকি গ্রামের বাতাসেও পাওয়া যাচ্ছে কফির ঘ্রাণ। এর অনিবার্য প্রভাব হিসেবেই হয়তো সীমিত পরিসরে হলেও দেশের মাটিতেও চাষ হচ্ছে কফি।
কফি চাষের এলাকা হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের দক্ষিণাঞ্চলেও কফির বেশ চাষ হয়। এবার ধীরগতিতে হলেও বাংলাদেশে এর চাষ এগোচ্ছে। দেশি কফি ক্রমে স্থানীয় বাজারে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
দেশের মাটিতে উৎপাদিত কফি নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের একজন শিরিন সুলতানা। দীর্ঘ ২২ বছর রাঙামাটিতে বসবাস করা শিরিন সেখানে কফি চাষ হতে দেখে উৎসাহিত হয়েছিলেন। স্থানীয় চাষিদের এই ব্যতিক্রমী কৃষিপণ্যের যথাযথ বিপণনের চেষ্টা থেকেই শিরিনের কফি বিক্রি শুরু হয়। বর্তমানে রাঙামাটিসহ দেশের তিন পার্বত্য জেলায়ই মূলত কফির চাষ হয়। আবার এই তিন জেলার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় বান্দরবানে।
কিভাবে শুরু করবেন—এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন শিরিন। তখন প্রথমে স্বামী তাঁকে অনলাইন উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফরম ‘উই’ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। তারপর থেকে শিরিন ধাপে ধাপে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পণ্য নিয়ে কাজ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি দেশে তৈরি কফির সঙ্গে কফিপ্রেমীদের পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যোগী হন বলে জানান শিরিন। তবে দেশি কফিকে ক্রেতাদের কাছে পরিচিত করতে এবং তার ওপর আস্থা তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে তাঁর।
শিরিন সুলতানা জানালেন, এখনো লোকে বিশ্বাস করতে চায় না যে দেশে আদৌ কফি উৎপাদিত হয়। ‘প্রথম প্রথম আমি যখন অনলাইনে বা অফলাইনে কাউকে বলতাম বাংলাদেশেও কফির চাষ হয়, অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইত না। পরে নিজে বাগানে গিয়ে কাঁচা-পাকা কফির সঙ্গে ভিডিওসহ পোস্ট দিলে ধীরে ধীরে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমি এখন পর্যন্ত ব্যবসার চেয়ে এটাকে একটা দায়িত্বই মনে করি। দেশি কফিকে দেশে ও বাইরে পরিচিত করাতে চাই,’ বলেন শিরিন।
এখন শিরিন তাঁর কফির জন্য নিয়মিত কিছু ক্রেতা পেয়েছেন। তাঁরা সব সময়ই তাঁর কাছ থেকে কফি নিচ্ছেন। বিশেষ করে ব্ল্যাক কফিপ্রেমীরা তাঁর নিয়মিত ক্রেতা। মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার কফি বিক্রি করেন শিরিন।
দেশে কফি চাষ ও বিপণনে নানা প্রতিবন্ধকতা আছে বলে জানান শিরিন। যেমন, পার্বত্য এলাকার চাষিদের অনেকেই আধুনিক কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নন। কফি সংরক্ষণ করাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সংরক্ষণ পদ্ধতি আরো উন্নত করার তাগিদ দিলেন এই উদ্যোক্তা। তাঁর মতে, কফি চাষে উদ্বুদ্ধ করা ও বর্তমানের সীমিত আকারের সরকারি সুবিধা বৃদ্ধি করা দরকার। এ জন্য চাষিরাও খুব বেশি আগ্রহ দেখান না।
শিরিন সুলতানা বললেন, মাঠে চাষিদের থেকে কফি কিনতে গেলে তাঁরা খুব খুশি হন। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন আরো বিস্তৃত পরিসরে আবাদ করে ভালো অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। সীমিত পরিসরে চাষ হওয়াতে ক্রেতা চাইলেও সারা বছর কফি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।
বিদেশি কফির চেয়ে দাম একটু বেশি দেশি কফির। এ কারণে অনেক ক্রেতার আগ্রহ কম। তবে স্বাদ ও গন্ধ নিয়ে কোনো ক্রেতার আপত্তি পাননি বলে জানান শিরিন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যান কৃষিবিষয়ক শাখার তথ্য মতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১১৮.৩ হেক্টর। মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ৫৬ টন। কৃষকরা চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করার কাজ সনাতন পদ্ধতিতে করায় বিনের ফলন তথা কফির উৎপাদন অনেক কম হয়। সেই কারণে লাভও কম হয়। দেশের চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশই পূরণ হয় আমদানি করা কফি দিয়ে।