মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুধ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে। করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক মহামন্দার মধ্যেও চাহিদার তুলনায় এসব খাদ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে দাম বেশি হওয়ায় আমিষের জোগান দেয়া এসব খাদ্য হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের পাতে আর উঠছে না।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি দামে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের কাছে মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রির পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারীদের সঙ্গে চলতি সপ্তাহে বৈঠক করে কীভাবে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুমোদনের জন্য তা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনির মতো ‘প্রতিদিন লাগে’ এমন সব খাদ্যপণ্য দরিদ্রদের কাছে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছে সরকার।
দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯২ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিক টন মাংস, ১৩০ দশমিক ৭৪ লাখ টন দুধ এবং ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৩৫ লাখ ডিম উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশ বাদে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। গত এক যুগে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে পাঁচ, আট ও চার গুণ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে ১৪০ দশমিক ১০ লাখ টন দুধ, ৮৬ দশমিক ৯০ লাখ টন মাংস এবং ২ হাজার ৩১৫ কোটি ৫৩ লাখ ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর গত অর্থবছরের থেকে এবার বেশি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। গত অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ৬৪ লাখ টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
আমিষের চাহিদা মেটাতে দিনে ২৫০ মিলিলিটার করে দুধ ও ১২০ গ্রাম করে মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া উচিত। উৎপাদনের সক্ষমতা অনুযায়ী একজন মানুষের এখন দিনে ১৪৭ গ্রাম করে মাংস এবং বছরে ১৩৬টি ডিম খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। দুধের উৎপাদন কিছুটা কম থাকায় সব মানুষ চাহিদা অনুযায়ী দুধ খাওয়ার সুযোগ পান না।
অন্যদিকে দিনে মাথাপিছু মাছ গ্রহণের চাহিদা ৬০ গ্রাম থাকলেও এখন তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মাছ উৎপাদন হচ্ছে দেশে। মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, ‘গত অর্থবছরে মাছ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে মাছ উৎপাদন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫০টির বেশি দেশে ৭৪ হাজার ৪২ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৫ হাজার ১৯১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে।’
টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার ঢাকার বাজারে রুই মাছ ৩৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ টাকা, গরু ৭০০ টাকা ও খাসির মাংস ৯৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। আর এক ডজন ফার্মের ডিমের দাম ছিল ১৫০ টাকা। মিল্ক ভিটা বাদে অন্য সব কোম্পানির প্যাকেটজাত দুধ ৯০ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। আঞ্চলিক বাজারগুলোতেও এখন প্রতি লিটার দুধের দাম ৭৫ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে। দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ চাহিদা অনুযায়ী আমিষজাতীয় এসব খাবার খেতে পারছেন না।
চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার না খেলে মানুষ প্রোটিন এনার্জি ম্যালনিউট্রিশনে ভুগবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস কে নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এর ফলে সব ধরনের রোগ মানুষের শরীরে বাসা বাঁধবে। তখন পুরো জাতি অসুস্থ জাতিতে পরিণত হবে। তখন রিকভারি করা কঠিন হয়ে যাবে।’
জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সে অনুযায়ী মানুষের বেতন বাড়েনি। ফলে বাধ্য হয়েই মানুষ পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব শিশুদের ওপর বেশি পড়বে, ভবিষ্যতে তারা প্রোটিনের অভাবে ভুগবে।’
সিপিডির তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় সব খাদ্যসহ সার্বিক খরচ ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছিল ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা, যা ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবরের খাদ্যপণ্যের মূল্য বিবেচনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। আর মাছ ও মাংস বাদ দিলেও চার সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা; যা ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ছিল ৬ হাজার ৫৪১ টাকা।
এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভর্তুকি দামে মাংস, ডিম ও দুধ বিক্রির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি, চলতি সপ্তাহে উৎপাদনকারীদের নিয়ে বসব। কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে তাদের মতামত নেয়া হবে। কোন পদ্ধতিতে এটা বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাব। আমরা যেসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন করি সস্তায় পুষ্টি নিশ্চিতে এর চেয়ে ভালো খাবার আর নেই। নিম্নবিত্তদের কাছে আমরা কম দামে এসব খাদ্যপণ্য পৌঁছাতে চাই।’
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ বিষয়ে প্রস্তাব দিলে আমরা অবশ্যই তা বিবেচনা করব। আমাদেরও ইচ্ছা আছে, আমরা এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’