জাতিসংঘ দিবস ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২০২২ সালে জাতিসংঘ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘Nourishing Peace’। শান্তি সমুন্নতির এই বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের আঙিনায় রাখা বক্তব্য এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তার নির্ভীক আহ্বান তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ দিবসের থিম অনুসারে কীভাবে খাদ্যনিরাপত্তা এবং শান্তি-প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একে অপরের সঙ্গে জড়িত তার স্বরূপ অন্বেষণেও শেখ হাসিনার সদিচ্ছার সম্বোধন ও মূল্যায়নের দাবি রাখে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমরা দেখেছি, কীভাবে পর্যাপ্ত এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাব সংঘাত উসকে দেয় এবং কীভাবে যুদ্ধ ও সহিংসতা সারা বিশ্বে খাদ্য সরবরাহের চেইনকে হুমকিজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন করে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে জাতিসংঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত এই সংস্থা কালের পরিক্রমায় কলেবরে বর্ধিত হয়েছে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৯৩। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দ্বন্দ্ব নিরসনে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে চলেছে এই সংস্থাটি। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয় ১৯৭৪ সালে। একই বছর বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো বাংলায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কন্যা শেখ হাসিনাও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ১৯ বার ভাষণ দিয়ে এবং সাহসিকতার সঙ্গে বিশ্বশান্তির পক্ষে কথা বলে প্রশংসিত হয়েছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অবদান রাখছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ‘বর্তমান বিশ্বে জাতিসংঘ আজ অপরিহার্য- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই’-জাতিসংঘকে আরও শক্তিশালী ও জোরদার করার জন্য সব সদস্যভুক্ত দেশের প্রতি এভাবেই একদা আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২.

১৭ অক্টোবর (২০২২) ইতালির এফএও-এর সদর দপ্তর রোমে অনুষ্ঠিত এফএও (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা) বিশ্ব খাদ্য ফোরাম ২০২২-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে ভার্চুয়ালি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে শেখ হাসিনা বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘যুদ্ধ থামান, সবার কাছে খাদ্য পৌঁছে দিন।’ তিনি যুদ্ধ ও খাদ্য নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে এবং সবার কাছে খাবার পৌঁছে দিতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তার পরিপ্রেক্ষিতও বর্ণনা করেছেন। বিশ্বের ৮০ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যা আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যব্যবস্থা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, কোভিড-১৯ মহামারি এবং আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে খরার কারণে বিপর্যস্ত- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে এফএওতে যোগদানে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জাতিসংঘের এই আন্তর্জাতিক সংস্থা নতুন দেশটির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী উদ্যোগের মধ্যে ছিল কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সবুজ বিপ্লবের ডাক দেয়া। বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়নের জন্য দেশের উন্নয়ন বাজেটের পঞ্চমাংশ বরাদ্দ করেন এবং কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।’ বঙ্গবন্ধু যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি তিনি একসঙ্গে এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে চান যেখানে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, যুদ্ধ এবং মানুষের দুর্ভোগ নির্মূল হবে এবং মানুষের কল্যাণের জন্য বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা সমুন্নত থাকবে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২২) জাতিসংঘের আঙিনায় দাঁড়িয়ে একইভাবে শেখ হাসিনা শান্তির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। উপরন্তু ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছরই জাতিসংঘে শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু।

৩.

‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই’ ২৩ সেপ্টেম্বর (২০২২) শুক্রবার বিকেলে (স্থানীয় সময়) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৭তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে এভাবেই বিশ্বশান্তির প্রতি জোর দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, যেকোনো ধরনের সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার সর্বোত্তম উপায় হলো সংলাপ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান। আর শান্তি ও স্থিতিশীলতা সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সব মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।’ গোটা মানবজাতিকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে বৈশ্বিক শান্তির জন্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সব ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ-সংঘাত এবং নিষেধাজ্ঞা বন্ধেরও ডাক দেন তিনি।

২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। এর আগে মিয়ানমার থেকে ধেয়ে আসা ১১ লক্ষাধিক রাখাইন মুসলিমকে এ দেশে আশ্রয় এবং শরণার্থী সমস্যাকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে নিজের নেতৃত্বকে আরও মহিমান্বিত করেছেন তিনি। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের মধ্যে জাতিসংঘে অনলাইন অধিবেশনেও যুক্ত ছিলেন শেখ হাসিনা। ২৬ সেপ্টেম্বর (২০২০) মহামারি দুর্যোগ মোকাবিলায় তার বিচক্ষণতাপূর্ণ ভাষণ সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। ২৩ তারিখেও (২০২২) তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মহামারিকে খুব ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে এবং মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।’

শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনের ভাষণে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমরা শান্তিকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছি। এ উপলব্ধি থেকেই সাধারণ পরিষদে ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ‘‘শান্তির সংস্কৃতি” শীর্ষক প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।’ ২৩ সেপ্টেম্বর (২০২২) জাতিসংঘে দেয়া তার আরও দুটি প্রত্যয়ী বাক্য হলো- ‘আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।’

প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের আঙিনায় শেখ হাসিনা তার একাধিক ভাষণে, জাতিসংঘে যোগ দেয়ার পর থেকে গত ৪৮ বছরে বিশ্বে দারিদ্র্যবিমোচন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া, রোগমুক্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষাসহ দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব প্রকল্প ও প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশ সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। অতীতে তিনি বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগিতার সম্পর্ক একবিংশ শতাব্দীতে আরও সম্প্রসারিত ও জোরদার করার কথা ক্রমাগত তুলে ধরেন। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশ মনে করে শান্তি একটি মৌলিক অধিকার, যাকে অর্জন, লালন, উন্নয়ন করতে হবে এবং সর্বদা ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে নিতে হবে। উন্নয়ন ছাড়া শান্তি সম্ভব নয় এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা। সে কারণেই দারিদ্র্যবিমোচন, ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর এবং উন্নয়নের জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে প্রকৃত সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।

লক্ষ করা যায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে অসাধারণ কথা উচ্চারণ করেছেন একটানা কয়েক বছর। তিনি বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, বিশ্বব্যাপী সুষম উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুধা ও পরমাণু অস্ত্রের শঙ্কামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আরও বলিষ্ঠ, কার্যকর, বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন বারবার। শেখ হাসিনার আহ্বান সবসময়ই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। একবিংশ শতাব্দীর বাসিন্দারা চায় যুদ্ধ ও সমরসজ্জার উন্মত্ততামুক্ত, পরমাণু অস্ত্রের শঙ্কামুক্ত এক শান্তিময় বিশ্ব; চায় রাজনৈতিক দিক থেকে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ পৃথিবী। বিশ্ববাসীর এই প্রত্যাশা পূরণের শেষ ভরসাস্থল হচ্ছে জাতিসংঘ। কারণ, একমাত্র জাতিসংঘই হচ্ছে এমন একটি বিশ্বসংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী স্থায়ী ও ব্যাপকভিত্তিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার কাঠামো নির্ধারণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করার জন্য পৃথিবীর মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কর্মোদ্যোগের প্রতিনিধিত্ব করে। আর সে কারণেই জাতিসংঘ তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই শতাব্দীতে এসে বিশ্ববাসী জাতিসংঘের কাছে আরও সক্রিয় ও বলিষ্ঠতর ভূমিকা প্রত্যাশা করে।

৫.

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসিত ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই তিনি দেশে দেশে অসহিষ্ণুতার অবসান ও শ্রদ্ধাবোধ সৃজনের কথা বলেন বারবার। যা যুদ্ধহীন ও সংঘাতমুক্ত টেকসই উন্নয়নের জন্য জরুরি কিন্তু জাতিসংঘ সেটা করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ। বিভিন্ন দেশে জাতি-ধর্ম নিয়ে সংঘাত লেগেই আছে যা শান্তি নষ্ট করছে। এসব সত্ত্বেও জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বর্তমান সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন তার মৌলিক চিন্তা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের মধ্য দিয়ে।

লেখক: মিল্টন বিশ্বাস
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়