কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, আউশ মৌসুমে কৃষকের সাশ্রয় ৭০ কোটি টাকা

চুয়াডাঙ্গা কৃষি কাজে ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। রোপা আউশ মৌসুমে হারভেস্টার ব্যবহার করে ধান কেটে কৃষকের প্রায় ৭০ কোটি টাকার শ্রমিকসহ অন্যান্য ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে বলে দাবি করছে কৃষি বিভাগ।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৩৮ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে রোপা আউশ ধানের আবাদ হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ১৪ হাজার ৪৬০, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৭ হাজার ৬৪১, দামুড়হুদা উপজেলায় ৮ হাজার ৬৪৮ ও জীবননগর উপজেলায় ৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে এ ধানের আবাদ হয়। এ মৌসুমে ৩০ হাজার ৯৫৯ হেক্টর জমির ধান কৃষকরা কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রের মাধ্যমে কেটেছে বলে এক তথ্যে জানানো হয়েছে, যা আবাদের ৮০ শতাংশ।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রকৌশলী বিভাগের তথ্যমতে জেলার ৪টি উপজেলায় ভর্তুকি মূল্যে এখন পর্যন্ত জাপানি ইয়ানমার ২৩টি ও কুবোতা ২৫টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্র বিতরণ করা হয়। এ যন্ত্রগুলো সদর উপজেলায় ১৬টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১৫টি, দামুড়হুদা উপজেলায় ১০টি ও জীবননগর উপজেলায় ৭টি বিতরণ করা হয়। যার সুবিধা পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা।

কৃষি বিভাগ জানায়, জমি আবাদযোগ্য করে তুলতে, মাড়াই ও সংরক্ষণ কাজের প্রতিটি ধাপেই ব্যবহার হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে ৯০ শতাংশ জমি চাষ, ৮০ শতাংশ সেচ কাজ, ৭০ শতাংশ ফসল উৎপাদন ও মাড়াই, ২ শতাংশ ফসল কাটা ও রোপনে ১ শতাংশ ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। প্রকার ভেদে যন্ত্রের চাহিদা আরও বাড়ছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ডিহি কেষ্টপুর গ্রামের কৃষক নূর ইসলাম ইসলাম বলেন, “গত দু’বছর আগে বৃষ্টির কারণে আড়াই বিঘা জমির ধান কাটতে না পারায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এই যন্ত্রগুলো পাওয়ায় সুযোগ-সুবিধা হয়েছে। অর্ধেক খরচে অর্থাৎ ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় প্রতি বিঘা জমির ধান কাটা, কাটা অংশ বাধা ও মাড়াই করে বস্তায় ভরে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি। আগে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে বিঘা প্রতি ৬ হাজার থেকে ৭ টাকা খরচ হতো। তাছাড়া বৃষ্টি হলেও ধান কাটা নিয়ে আমাদের আর ভাবনা নেই। জমিতে যত বৃষ্টির পানিই থাক না কেনো, এ যন্ত্রের মাধ্যমে সহজেই ধান কাটা যাচ্ছে।’

একই উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম জানান, কম সময়ে অল্প খরচে আমরা ধান কাটতে পেরেছি। বৃষ্টির পানির মধ্যে ধান কাটার জন্য কোনো লোকজন পাওয়া যায় না। বৃষ্টির কারণে খরচ বেশি লাগে। এ সময়ে পানির মধ্যে ধান কাটা কষ্ট ছিলো। এই যন্ত্রে এক ফুট পানির মধ্যেও ধান কেটে জমি থেকে একবারে আমরা বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আমার ৪ বিঘা ধান লোকজন দিয়ে কাটলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হতো। এই যন্ত্রের কারণে ৪ জমির ধান ১০ হাজার টাকা খরচে ধান কাটতে এবং তা ২ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে হাটে বিক্রি করতে পেরেছি।’

একই গ্রামের শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ যন্ত্র দিয়ে ১০ বিঘা জমির ধান কাটিয়েছি। এই হারভেস্টার মেশিন কৃষকদের জন্য লাভজনক। লোকজন দিয়ে ধান কাটতে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হতো। কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কেটে ১০ হাজার টাকা খরচ করে ধান ঘরে তুলতে পেরেছি।’

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান রাজু বলেন, ‘চেয়ারম্যান হলেও আমি একজন কৃষক। পরিবারের শত বিঘা জমি চাষ করছি। নিজের এলাকায় কৃষকদের সহযোগিতার জন্য কৃষি অফিস থেকে ভর্তুকি মূল্যে যে কম্বাইন্ড হারভেস্ট মেশিন নিয়েছি, তা আমার এলাকার প্রান্তিক কৃষকদের কথা চিন্তা করে এবং আমার চাষের ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য। এর মাধ্যেমে আমি যেমন উপকৃত হচ্ছি, তেমনি আমার এলাকার প্রান্তিক কৃষকরা অল্প সময়ে ধান ঘরে তুলতে পারছে। সব মিলিয়ে সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেটা যুগোপযোগী। এটা ধারাবাহিকভাবে চালু রাখলে কৃষকরা উপকৃত হবে।’

চুয়াডাঙ্গা জেলা কম্বাইন্ড হারভেস্টার মালিক সমিতির সভাপতি নূর আলম লিটন জানান, কম্বাইন্ড হারভেস্টারের কারণে কৃষকরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন, আমরাও তেমনি কৃষকের ধান কেটে দিয়ে লাভবান হচ্ছি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টারের বড় সুবিধা মাত্র ১ ঘণ্টায় ৩ বিঘা জমির ধান কেটে মাড়াই করে বস্তাবন্দি করে ঘরে তুলে দিতে পারা। বৈরি আবহাওয়ায় এই যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটা সম্ভব। চলতি মৌসুমে প্রায় ৮০ শতাংশ ধান কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহার করে কাটা হয়েছে। রোপা আউশ মৌসুমে হারভেস্টার ব্যবহার করে ধান কেটে কৃষকের প্রায় ৭০ কোটি টাকার শ্রমিকসহ অন্যান্য ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। যদিও কিছু এনজিও সরকারের এই অসাধারণ কৃষিবান্ধব উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অর্থের বিনিময়ে কম্বাইন্ড হারভেস্টর মেশিন নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। বহু আগে থেকেই বিভিন্ন দাতা সংস্থা কৃষিতে ভর্তুকি না দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেয় প্রতিনিয়ত। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এই ধরণের স্থানীয় এনজিওকেও চিহ্নিত করা হবে।’

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, ‘উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে এই কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্র কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রপাতি ফসল উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০ লাখ টাকার কম্বাইন হারভেস্ট যন্ত্র একজন কৃষক ১৪ লাখ টাকায় নিতে পারবেন। এ বার কম্বাইন্ড হারভেস্টারের সাহায্যে মাঠে মাঠে কৃষকের আউশ ধান কাটা হয়েছে।’