চারদিক বিশাল পদ্মা ও যমুনা নদী এবং তাদের শাখা ক্যানাল দ্বারা বেষ্টিত দুর্গম কুশাহাটার চর। অশিক্ষা ও রুগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠছে এখানকার শিশুরা। এখানে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চরমভাবে পিছিয়ে থাকা এই চরে আলোকবর্তিকা হয়ে শিক্ষার আলো জ্বালাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মো. ওয়াজউদ্দিন সরদার (৩২) নামের এক যুবক।
জানা গেছে, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত এ চরটি। ১৯৯৮ সালে পদ্মা নদীতে বিলীন হওয়ার কয়েক বছর পর পুনরায় চরটি জেগে ওঠে। গত কয়েক বছরে সেখানে এক এক করে বর্তমানে ১৩২টি পরিবারের বসবাস। কিন্তু দুর্গম সেই চরে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ট্রলারযোগে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তাল নৌপথ পাড়ি দিয়ে এ চরে যাতায়াত করতে হয়। চরের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ২০১৭ সালে পায়াক্ট বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন ওই চরে ‘কুশাহাটা পায়াক্ট বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুলে যোগ দেন চরের একমাত্র এসএসসি পাস যুবক মো. ওয়াজউদ্দিন সরদার। সম্মানী হিসেবে দেওয়া হতো এক হাজার টাকা। যদিও গত দুই বছর ধরে সে ভাতাও বন্ধ।
পায়াক্ট বাংলাদেশের দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মজিবর রহমান জুয়েল বলেন, ‘বর্তমানে স্কুল চালানোর বিষয়ে তাদের কোনো প্রকল্প বা ডোনার নেই। অভিভাবকদের সহযোগিতা ও আমাদের ব্যক্তিগত অনুদানে শিক্ষককে যৎসামান্য সম্মানি দেওয়া হয়।’ এ ছাড়া সরকারিভাবে বই সংগ্রহ করে বিতরণ ও বছরের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ দিয়ে থাকেন তারা। বর্তমানে এ স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২২ জন।
প্রাথমিকভাবে স্কুলের জন্য একটি ছোট্ট ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে তিন বছর আগে সেটা প্রবল ঝড়ে ভেঙে পড়ে। টাকার অভাবে সেটি আর গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। যে কারণে বর্তমানে শিক্ষক ওয়াজউদ্দিনের বাড়ির আঙিনার গাছতলাতেই চলে শিক্ষা কার্যক্রম। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
শিক্ষক ওয়াজউদ্দিন বলেন, ‘আমি নদী ভাঙনের শিকার একজন ভূমিহীন মানুষ। লিজ নেওয়া সামান্য জায়গায় বসবাস করি। তারপরও বাচ্চাদের প্রতিদিন আমার বাড়ির আঙিনায় পাঠদান করি। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করে আনি। এরপর আমি ও আমার অষ্টম শ্রেণি পাস স্ত্রী রুখসানা আক্তার মিলে বাচ্চাদের পড়াই। বিনিময়ে দরিদ্র অভিভাবকরা যে যা দেন, তাই গ্রহণ করি। তাতে স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তানের সংসার চলে না। খুব কষ্টেই দিন কাটে। তবুও চরের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ স্থানীয় সালাম মণ্ডল, নিয়ামত খান, সোরাপ আলী মণ্ডল, জবেদা খাতুন, সেলিনা বেগমসহ অনেকেই বলেন, আমরা সবাই ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ। মাছ ধরে, জমিতে কাজ করে কোনো মতে পেট চালাই। তারপরও চাই আমাদের সন্তানরা কিছুটা হলেও লেখাপড়া শিখুক। কিন্তু স্কুল না থাকায় খুব সমস্যা হচ্ছে। এর মধ্যেও ওয়াজউদ্দিন মাস্টার বাচ্চাদের পড়ান। আমরা মাসে ৫০-১০০ টাকা করে যে যা পারি দিই। তিনি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে, যত্ন করে পড়ান।
গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোস্তফা মুন্সি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুশাহাটা চরে একটি স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে জমি কিনে মাটি ভরাট করেছি। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। ওয়াজউদ্দিনসহ যারা বর্তমানে চরের শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। চরবাসীর যেকোনো প্রয়োজনে আমি সর্বদা তাদের পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ।’
এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ চরবাসীর সমস্যাগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। আশা করছি তাদের সকল চাহিদাই ধীরে ধীরে পূরণ হবে।’