দক্ষিণের আশীর্বাদ নবনির্মিত বঙ্গমাতা সেতু

একটা দেশের উন্নয়নে এবং মানুষের সুবিধার্থে সর্বাগ্রে দরকার নিরাপদ ও দ্রুতগতিসম্পন্ন অবকাঠামো। অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশ্নে আবহমান নদীমাতৃক বাংলায় অতীতে বড় বাধা ছিল দেশব্যাপী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদনদী। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিতে নদনদীর ওপর সেতু তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। সেদিন পেরিয়েছে। সেতুর কল্যাণে আজকের বাংলাদেশকে নিরবিচ্ছিন্ন কানেকটিভিটির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতুর পর সম্প্রতি ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু’ জনগণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে খুলনা-পিরোজপুর-বরিশাল রুটে শুরু হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের সঙ্গে এই অঞ্চল কানেকটিভিটির আওতায় এসেছে। এই সংবাদ পরমানন্দের।

দীর্ঘ ৪৫ বছর আগে বাংলাদেশ-চীন কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে আজ পর্যন্ত চীন সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে আটটি সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতুগুলো বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নামেই সমধিক পরিচিত। সর্বশেষ বাংলাদেশ ও চীনের অর্থায়নে পিরোজপুরের কঁচা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয়ের ৬৫৪.৮০ কোটি টাকা চীন এবং বাকি ২৩৯.৮০ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার সংস্থান করেছে। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ পিরোজপুরের এক জনসভায় কঁচা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর তিনি সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। আনন্দের বিষয় হলো, তিনিই ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সেতুটির শুভ উদ্বোধন করেছেন ।

স্বস্তির সঙ্গে বলতে হয়, এই সেতুর মাধ্যমে বরিশাল বিভাগীয় শহরের সঙ্গে খুলনা বিভাগীয় শহরে তৈরি হয়েছে বাধাহীন যোগাযোগব্যবস্থা। সেতুটি চালু হওয়ার আগে বরিশাল-পিরোজপুর-খুলনা রুটে যাতায়াতের জন্য ফেরিই ছিল একমাত্র ভরসা। কয়েক ঘণ্টা সময় ফেরি ঘাটে ব্যয় হতো। এখন সেতু চালু হওয়ার ফলে এক দিকে সময় যেমন সাশ্রয় হচ্ছে তেমনি অনায়াসে এ রুটের কর্মজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছে। মোটাদাগে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনে সেতুটি গভীর সমদ্রবন্দর পায়রার সঙ্গে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করেছে। সামরিক কাজে পটুয়াখালীর শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে যশোর সেনানিবাসের সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনে বেশ ভূমিকা রাখছে নবনির্মিত সেতু। উপরন্তু বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত সাগরকন্যা কুয়াকাটায় দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠতে বিরাট অবদান রাখবে এই সেতু, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয় তখন সারা দেশে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল নড়বড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সড়ক যোগাযোগের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সকলেরই জানা, যোগাযোগব্যবস্থা হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশত। দেশব্যাপী, বিশেষ করে বিগত এক দশকে, যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত রাষ্ট্র। এই স্বপ্নের বাস্তবায়নের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সদ্য নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের আরেক বিষ্ময়—বহুমুখী পদ্মা সেতু, যা ছিল কোটি মানুষের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাতে উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্তে। বলতেই হয়, নবনির্মিত সেতুগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ তো বটেই, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নকে আরো বেশি চাঙ্গা করবে। নতুন নতুন শিল্পায়নের পথ প্রসারিত করবে।