বান্দরবানে এলাচ চাষে সাফল্যের হাতছানি

মসলা জাতীয় ফসল এলাচ আগামীতে আর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে না, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে দেশের মাটিতে উৎপাদিত এলাচ। এতে অনেক বেকার মানুষের যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, তেমনি দেশেও আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নাম থাকবে এলাচ রপ্তানির তালিকায়, এমনটাই আশা করছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে প্রথমবারের মতো এলাচ চাষ করা এক স্কুলশিক্ষক মেনয়াং ম্রো।

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের ওয়াইজংশন এলাকার দেওয়াই হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মেনয়াং ম্রো তার পতিত পাহাড়ের পাদদেশে প্রথমবারের মতো শুরু করেছেন এলাচ চাষ। তিন পার্বত্য জেলায় মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালে যশোরের বেনাপোল এলাকার এক চাষির কাছ থেকে ১২০টি এলাচ চারা সংগ্রহ করে বান্দরবানের পাহাড়ে শুরু করেন এলাচ চাষ। আমদানি নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নিয়ে পাহাড়ের বুকে সবুজ রংয়ের এলাচ চাষ শুরু করেন তিনি। অনলাইন থেকে এলাচ চাষের পদ্ধতি সর্ম্পকে ধারণা নিয়ে এক একর জমিতে এলাচের আবাদ করে খুশি স্কুলশিক্ষক মেনয়াং ম্রো।

তিনি বলেন, ভারত, চীন ও মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের উর্বর জমি এলাচ চাষের জন্য বেশ উপযোগী, কিন্তু এতদিন আমরা এটি চাষে আগ্রহী না হওয়ায় পিছিয়ে ছিলাম। আমি অনেক দিন ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখার পর হঠাৎ সন্ধান পেলাম যশোরের শাহাজান নামে এক ব্যক্তি বাংলাদেশে এলাচ চাষ শুরু করেছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০১৮ সালে আমি তার কাছ থেকে ১২০টি এলাচের চারা সংগ্রহ করে বান্দরবানে এনে চিম্বুক পাহাড়ের ওয়াইজংশন এলাকার পতিত জমিতে রোপণ করি, পরে সেই চারা থেকে বর্তমানে আমার বাগানে প্রায় কয়েক হাজার চারা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এলাচ চাষের জন্য আলাদা কোনো জমি প্রয়োজন হয় না। এটি ছায়াযুক্ত স্থানে যে কোনো গাছের ছায়ার নিচে জন্মাতে পারে। বর্তমানে আমি নিজে বেশ কিছু এলাচের চারা করছি, যা বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেব। আমি যশোর থেকে প্রতিটি চারা ৩০০ টাকা করে কিনেছিলাম। পরিবহন খরচসহ মোট ৩৫০ টাকা করে গড়ে খরচ পড়েছিল। বর্তমানে আমিও এলাচের চারা উৎপাদন করছি এবং আমি আমার উৎপাদিত চারা এলাকায় সম্প্রসারণের জন্য ৩৫০ টাকা করে বিক্রি করছি।

যেদিন আমার অনেক চারা উৎপাদিত হবে, সেদিন বিনামূল্যে আমি এলাচের চারা তিন পার্বত্য জেলায় ছড়িয়ে দেব, আমি আশা করছি, তিন পার্বত্য জেলায় এলাচ চাষ বাড়লে একদিন বাংলাদেশ থেকে এলাচ বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে, যোগ করেন তিনি।

মেনয়াং ম্রো আরও বলেন, ভারত, চীন ও মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের বান্দরবানের পাহাড়ের ভূমিগুলো এলাচ চাষের জন্য বেশ উপযোগী, আর একটি এলাচ গাছ কমপক্ষে ৩০ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। এলাচ চাষের সুবিধা হচ্ছে, এর জন্য আলাদা কোন জমি দরকার হয় না, যে কোনো ফলের বাগানে গাছের ছায়ায় এলাচ চাষ সম্ভব।

এদিকে মেনয়াং ম্রোর এলাচ চাষ দেখে আশেপাশের চাষিরাও আগ্রহী হচ্ছেন এলাচ চাষে।

স্থানীয় বাসিন্দা ক্রতাং ম্রো জানান, আমরা সাধারণত পাহাড়ে পেঁপে, কলা, আদা, হলুদ, আম, মিষ্টি কুমড়া চাষ করে থাকি। কিন্তু আমাদের পাড়ার স্কুলশিক্ষক মেনয়াং ম্রো তার বাগানে বিভিন্ন চাষের পাশাপাশি দামি মসলা এলাচের চাষ করেছেন। বর্তমানে তার এলাচ গাছে বেশ ফলনও এসেছে, আমরাও তার দেখাদেখি আগামীতে এলাচ চাষ শুরু করব।

স্থানীয় চাষি ফ্লোগান ম্রো বলেন, মেনয়াং ম্রো এর এলাচ চাষ দেখে আমি বেশ আগ্রহী হয়েছি, আমি তার কাছ থেকে চারাও সংগ্রহ করতে এসেছি। এ বছর থেকে আমিও বেশ কিছু এলাচের চারা রোপণ করব। পাহাড়ে এলাচ চাষ হওয়ায় কিছু বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে চাষিরা আসছেন, এলাচ চাষ শিখতে।

মেনয়াং ম্রো জানান, বছর দুই ধরে তার বাগানের অনেক গাছে এলাচ ধরতে শুরু করেছে। তবে এখনো বাণিজ্যিকভাবে এলাচ বিক্রি করতে শুরু করেননি তিনি। চারা বিক্রি করেই ভালো আয় হচ্ছে তার। তার বাগানে প্রয়োজন অনুযায়ী দিনমজুর কাজ করে থাকে। এলাচের পাশাপাশি আম, কাঁঠাল, আনারসসহ বিভিন্ন ফলের বাগান রয়েছে তার।

বান্দরবান সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বলেন, পার্বত্য এলাকায় এলাচ চাষে সফলতা পেয়েছেন স্কুল শিক্ষক মেনয়াং ম্রো, প্রাথমিকভাবে ১২০টি চারা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তার বাগানে এখন হাজার খানেক চারা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রোপণের দুই বছর পর থেকে ফলন আসে। তবে তা অল্প, এলাচ গাছ রোপণের পাঁচ বছর পর থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়। প্রতি গাছের গোড়ায় মাটি সংলগ্ন হয়ে গুচ্ছ আকারে ফুল হয় লতার মতো, সেই ফুলগুলো থেকে ফল হয় গুচ্ছ আকারে। প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে ফলন হয়। প্রতি গুচ্ছে ৯০০-১০০০ গ্রাম পর্যন্ত ফলন হয়। সাধারণত ফুল আসা শুরু হয় মে মাসে এবং ফল পরিপক্ক হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তখন বাগান থেকে কাঁচা এলাচ সংগ্রহ করে রোদে শুকাতে হয়। বেশি উৎপাদন হলে ড্রায়ার মেশিনে শুকাতে হয়, না শুকিয়ে ঘরে রাখলে পচন ধরবে। ফল পরিপক্ক হলে দেখতে কিছুটা সবুজের ওপর লালচে হবে।

কৃষি কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক আরো জানান, একটি গাছে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত ফল হয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন হয় না, ফলের বাগানে ছায়াযুক্ত স্থানে এলাচ ভালো জন্মে। কৃষির উন্নয়নে এ ধরনের চাষিদের সার্বিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার জন্য আমরা সচেষ্ট রয়েছি। সরকারিভাবে পার্বত্য এলাকার কৃষকদের আরও বিভিন্ন সহায়তা দিলে বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষ বাড়বে। আর তাতে পাহাড়ের এলাচের ঘাটতি মিটিয়ে দেশের নানান প্রান্তে এলাচ রপ্তানি করা সম্ভব হবে।