ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাফসিরুল ইসলাম জন্মগতভাবে দৃষ্টিহীন। ক্লাস চালিয়ে নিলেও তাঁর পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টি অন্যদের মতো সুখকর হয় না। তিনি মুখে বলেন আর শ্রুতিলেখক তা খাতায় লেখেন। ছোটবেলা থেকে এভাবেই চলছে তাঁর পড়াশোনা।
তাফসিরুল জানান, পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক পেতে তাঁকে খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পরীক্ষার সময় সবাই প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাঁকে শ্রুতিলেখক খুঁজে বের করে তাঁর কাগজপত্র নিয়ে বিভাগ, ডিন অফিস এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে দৌড়াতে হয়। শ্রুতিলেখক আসতে দেরি করলে তিনি পরীক্ষা শুরু করতে পারেন না। তবে এমন বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি মিলছে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের।
এ সমস্যা দূর করতে এগিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শোয়াইবের নেতৃত্বে গবেষকরা ব্রেইল থেকে বাংলা লেখায় রূপান্তর করার একটি সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছেন। গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করেন।
ব্রেইল হলো ছয়টি বিন্দুর সমন্বয়ে দৃষ্টিহীনদের লেখার একটি পদ্ধতি। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই ছয়টি বিন্দুর নকশা অনুযায়ী লেখেন এবং হাত বুলিয়ে অর্থ বুঝতে পারেন। সেই ব্রেইল লেখা বাংলা লেখায় রূপান্তর করবে সফটওয়্যার। ফলে সবাই সেটি বুঝতে পারবেন। অন্য কয়েকটি ভাষায় থাকলেও বাংলা ভাষার ব্রেইল রূপান্তর এই প্রথম।
এর ব্যবহার শুরু করা গেলে উপকৃত হবেন বাংলা ভাষাভাষী দৃষ্টিহীন সবাই। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ব্রেইলও এই সফটওয়্যার লেখায় রূপান্তর করতে পারবে বলে জানান গবেষক দলের সদস্য সহকারী অধ্যাপক আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, পরীক্ষার বিষয়টি ছাড়াও দৃষ্টিহীন কেউ গল্প, কবিতা বা গান লিখতে চাইলে সেটি ব্রেইলে লিখে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাংলা লেখায় রূপান্তর করতে পারবেন। এতে কোনো ইন্টারনেট সংযোগের প্রয়োজন হবে না। এটি ৯৮ দশমিক ৮১ শতাংশ নির্ভুল রূপান্তর করতে সক্ষম। অনেক পুরোনো অথবা দাগযুক্ত কাগজ থেকেও এটি রূপান্তর করতে পারে। এটির আরও উন্নতি ঘটানোর কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
২০১৬ সালে সফটওয়্যারটির কাজ শুরু করেন জানিয়ে আহমেদুল কবির বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের জন্য কিছু করার জন্যই এই প্রয়াস। এটি শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট এবং টিউটোরিয়াল জাতীয় ছোট কাজে প্রথমে শুরু করা হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট হলে পরীক্ষায়ও এটি ব্যবহার করা হবে। তিনি আরও বলেন, বিদেশে এ রকম কাজের জন্য কোটি টাকা বাজেট হয়। তাঁরা অনেক অল্প টাকায় কাজটি করেছেন। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে একটি কাজ চলমান আছে বলেও জানান তিনি।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সফটওয়্যারটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন আহমেদুল কবির। এ সময় তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা এটি ব্যবহার করবেন এবং ধীরে ধীরে সব শিক্ষার্থী এবং বিদেশেও এটি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। গবেষণার দীর্ঘ সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মিনহাজ কামাল, আতিক আহমেদ, আরমান হোসেন, সাদিকুল হক সাদি এ কাজে অবদান রেখেছেন।
উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, পরিপূর্ণভাবে সফটওয়্যারটির চালু হয়ে গেলে কোনো শিক্ষার্থীর শ্রুতিলেখক লাগবে না। এখন এটির পেটেন্টিংয়ের প্রয়োজন হবে। বিভিন্ন ফার্ম বা কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করতে হবে, যাতে সবাই এটি ব্যবহার করতে পারেন। কপিরাইট থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।