বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কমিটির করা ৭৬টি গুমের অভিযোগের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই কোনো মামলা বা সাধারণ ডায়রি (জিডি) পায়নি সরকার। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ গঠিত কমিটি ও স্পেশাল র্যাপোর্টিয়াররা গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারকে গুমের অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানাতে চিঠি দিয়েছিলেন। এরপর মে মাসে জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে পাঠানো ফিরতি চিঠিতে সরকার অভিযোগগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সরকার বলেছে, কেউ নিখোঁজ হওয়ার অর্থ গুম হওয়া নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রক্রিয়ার উচিত গুমের অভিযোগ পেলে আগে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা। বিশেষ করে গুমের অভিযোগের বিষয়ে কোনো মামলা বা আইনি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।
চিঠিতে সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুনাম অর্জনকারী আইন প্রয়োগকারী বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করেছে। র্যাবের এযাবৎ অর্জনগুলোও তুলে ধরেছে সরকার। র্যাব বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়ার কয়েকটি ঘটনার সচিত্র তথ্যও চিঠিতে যুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি শৃঙ্খলা ভাঙার দায়ে র্যাবের জবাবদিহি ও শাস্তির ঘটনাগুলোর তথ্য তুলে ধরেছে সরকার।
জাতিসংঘের কমিটি ও স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারদের ‘জরুরি আবেদনের’ জবাবে বাংলাদেশ বলেছে—নিখোঁজ হওয়ার সব ঘটনাকে ‘গুম’ বলে চালিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা সরকার লক্ষ করেছে। সরকার ও তার অর্জনকে হেয় করতে ইচ্ছা করেই এটা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় ‘গুম’ বলে কোনো শব্দ নেই। তবে ফৌজদারি আইনে ‘কিডন্যাপিং’ বা ‘অ্যাবডাকশন’ (অপহরণ) বিষয়ে বিধান আছে।
এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে সবার জন্যই প্রযোজ্য। চিঠিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাঠামোকে বলেছে, যারা গুম হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে, তাদের অনেকেই আবার ফিরে আসে। অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে সরকার দেখতে পেয়েছে, পারিবারিক বিরোধ বা মামলা থেকে বাঁচতে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে বিব্রত করতে অনেকে স্বেচ্ছায় লুকিয়ে ছিল। তাদের অনেকের ফিরে আসার তথ্য সরকার আগেই জাতিসংঘ কাঠামোকে জানিয়েছে।
গুমবিষয়ক জাতিসংঘ কমিটি গত ডিসেম্বরে ৭৬টি গুমের অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশকে তালিকা দিয়েছিল। গত মে মাসের চিঠিতে সরকার জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের বলেছে, ওই ব্যক্তিদের উদ্ধার বা অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক ঘটনায় থানায় কোনো অভিযোগ আসেনি। মামলা হয়নি আদালতেও। তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যখন তাদের বাড়িতে গেছে, তখন একে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হুমকি, ভয়ভীতি দেখানো বা হয়রানি হিসেবে অভিযোগ করা হয়েছে।
সরকার একটি চিঠির নমুনা জাতিসংঘকে দিয়ে বলেছে, কথিত গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনরা যখন সহযোগিতা করেনি, তখন তথ্য চেয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চিঠি পাঠিয়েছে। তখনও অভিযোগ উঠেছে, সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে। সরকার জোর দিয়ে বলছে, এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সরকার কথিত গুম হওয়া ব্যক্তিদের মুখ বন্ধ করা নয়, বরং তাদের আইনি সুরক্ষার সুযোগ করে দিতে চায়।
সম্প্রতি ঢাকায় এসেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেত। গত ১৭ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, নির্যাতনবিরোধী জাতিসংঘ কমিটিসহ বিভিন্ন জাতিসংঘ কাঠামো বেশ কয়েক বছর ধরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। ওই অভিযোগগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে দায়ী করা হয়েছে।
মিশেল বাশেলেত সরকারের মন্ত্রীদের কাছে ওই অভিযোগগুলোর বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি নিরাপত্তা খাতের সংস্কারের পাশাপাশি অভিযোগগুলোর ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে গেছেন।