ইলিশ উৎপাদনের ধরে রাখতে হবে সাফল্য

মা-ইলিশ শিকারের ওপর অবরোধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উত্পাদন বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাছের বাজারে গেলে চোখে পড়ে বড় বড় রুপালি ইলিশ। স্বাদ ও সাধ্য মিলিয়ে কেনা যায় পছন্দের ইলিশ, তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশের দাম একটু চড়া। ইলিশ চর্বিযুক্ত মাছ আর ইলিশে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড) রয়েছে।

মত্স্য বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধু ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। নদী ও সাগর দুই পদের ইলিশই টর্পেডো আকারের। কিন্তু নদীর ইলিশ একটু বেঁটে ও খাটো হয়, আর সাগরের ইলিশ হয় সরু ও লম্বা। সেইসঙ্গে নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ বেশি চকচকে হয় এবং রং একটু বেশি রুপালি হয়। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল। এছাড়া নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার পটলের মতো হয় অর্থাৎ মাথা আর লেজ হয় সরু আর পেটটা হয় মোটা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রাচুর্য দেখে মনে যেন, ইলিশের সেই সুদিন আবার ফিরে এসেছে। বিগত বছরগুলোতে যে ওজনের একটি ইলিশ মাছের দাম যা ছিল, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকটা নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। তাছাড়া দেড়-দুই কেজির ওজনের পর্যাপ্ত ইলিশ ইদানীং বাজারে দেখা যাচ্ছে, আগে যা ছিল স্বপ্নের মতো। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মেঘনা নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল ৩ কেজি ৬০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ, যা বিক্রি হয়েছিল ১৪,৫০০ টাকায়।

ইলিশ শুধু স্বাদে ও গুণে অনন্য নয়, ইলিশ একটি ব্রান্ড এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আমাদের সরকার কয়েক বছর ধরে উপহার হিসেবে ইলিশ ভারতে পাঠিয়েছে এবং গণমাধ্যম বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। তখন ইলিশ হয়ে ওঠে কূটনীতি ও আভিজাত্যের প্রতীক। বাংলাদেশ ২০১৯ সালে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতে ৫০০ টন ইলিশ রপ্তানি করেছিল, এরপর ২০২০ সালে ১,৮৫০ মেট্রিক টন এবং ২০২১ সালে ১,২৩২ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি করেছে। বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উত্পাদন হচ্ছে। মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ শতাংশ এবং দেশের মোট মত্স্য উত্পাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ প্রায় ১২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইলিশ উত্পাদন হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫৬ হাজার টন অর্থাৎ বিগত ১২ বছরে ইলিশের উত্পাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

মত্স্য অধিদফতরের মতে, প্রায় ৫ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম মূলত দুটি—সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্র মাস থেকে মধ্য কার্তিক) ও জানুয়ারি থেকে ফেব্র‚য়ারি (মধ্য পৌষ থেকে মধ্য ফাল্গুন)। তবে দ্বিতীয় মৌসুমের তুলনায় প্রথম মৌসুমে প্রজনন হার বেশি। ইলিশ নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। উল্লিখিত সময়ে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্হা চালু রাখায় ইলিশের উত্পাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং বাজারে সরবরাহও সহজলভ্য হয়েছে।

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সুস্বাদু খাবার হিসেবে অর্থনীতিতে এর বিশেষ ভূমিকা আছে। তাই ইলিশ উত্পাদনে ধারাবাহিকতা রাখতে হলে চলমান প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জেলেদের আরো সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃত জেলেদের প্রণোদনা দিতে হবে বেশি বেশি। তাহলেই ভবিষ্যতে সুফল পাওয়া যাবে। একইসঙ্গে মাঠ প্রশাসনের সুষ্ঠু তদারকির পাশাপাশি কঠোর নজরদারি যেমন দরকার, ঠিক সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও জেলেদের সচেতন হওয়া একান্ত জরুরি। বাঙালির ঐতিহ্য রুপালি ইলিশের দাম যেন সাধারণের সাধ্যের মধ্যে ঝিলিক ছড়ায়—এটাই প্রত্যাশা।