বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোন সংকট দেখছে না আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বৈশি^ক পরিস্থিতির কারণে সাময়িক সংকটে পড়লেও এ থেকে উত্তরণের ক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। অর্থনীতি সমীক্ষার প্রাক্কলিত আসন্ন মন্দা কাটিয়ে ওঠার শক্তিও বাংলাদেশের আছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফের সাথে একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা। দেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতির সংকট খুবই সাময়িক বলে মন্তব্য করেন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশের জনগণ আরেকটু সচেতন হলেই যেকোন সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে না বলেও জানান কেউ কেউ।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমাদের জাতিগত ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। দেশের দুর্যোগে, সংকটে একযোগে সবাই কাজ করেছে। যে কোন সময়, যে কোন অবস্থায় দল-মত নির্বিশেষে একজোট হয়ে সংকট মোকাবেলা করার ইতিহাস আমাদের রয়েছে। তাই এ অবস্থায় যে সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে তা আসলে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। এ অবস্থা কেটে যাবে অচিরেই। সে বিষয়টিই আইএমএফ বলেছে।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সময়ের আলোকে বলেন, ‘এ দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও বড় সংকট এর আগে নানান সময়ে এসেছে। সেসবই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে এগিয়ে গিয়েছি। ২০০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটেও আমাদের দেশ ছিলো অনন্য। এ জন্য অবশ্যই প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অবদান রাখেন অনেক বেশি। চলমান এ সংকটও অতটা গভীর হবে না। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোও বাংলাদেশকে ঋণ দিতে চিন্তা করে না। অথচ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলোও চেয়েও ঋণ পাচ্ছে না। আর এসব সংস্থা বাংলাদেশকে ঋণ দিতে স্বেচ্ছায় প্রস্তাব দেয়।’
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই হিমশিম খাচ্ছে অর্থনীতি সামলাতে। যুক্তরাজ্যে রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতি। ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কয়েকটি দেশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন অবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তা খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। এমতাবস্থায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। আমরা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, ‘শুধু আইএমএফই নয়, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও এখন ঋণ দিতে আর কোন টালবাহানা করবে না। কারণ আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পেয়েও পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করেছি। আমাদের দেশের এমন আত্মবিশ্বাস দেখে কেউই কোন অজুহাতে ঋণ দেওয়া বন্ধ রাখবে না।’
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী ঘোষিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের পর ঋণ নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার মতো দেশ প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় আশঙ্কা আরো গভীর হয়। তবে, আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির মতে বাংলাদেশের এমন কোন শঙ্কা বা ভয় নেই।
এদিকে, বাংলাদেশকে ঋণ দিতে কোন ধরনের শর্ত দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছে আইএমএফ। সংস্থাটির প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনান্দ মঙ্গলবার বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি একান্তই বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত। আমরা কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেইনি। এ ক্ষমতাও আমাদের নেই।
এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আইএমএফ কোন শর্ত দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না। আইনগত কোন ভিত্তিও নেই। বড়জোর আমাদের সুপারিশ করতে পারে বিভিন্ন বিষয়ে। আইএমএফ কিন্তু একবারও বলেনি যে তেলের দাম বাড়াতে। তারা প্রস্তাব দিয়েছে তেলের ভর্তুকি কমাতে। এমন প্রস্তাব বা সুপারিশ দেওয়া দোষের নয়।’
এর আগে মঙ্গলবার বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনান্দ বলেন, আমরা কোন শর্ত দেইনি। বাংলাদেশকে ঋণ দিতে আগ্রহী আমরা। তাই এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় দফা সফরে এসেছি। এসময় যুক্ত ছিলেন সংস্থাটির পলিসি অ্যান্ড রিভিউ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর উমা রামাকৃষ্ণান।
একই অনুষ্ঠানে রাহুল আনান্দ বলেন, বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অক্টোবরে নেওয়া হবে। আইএমএফের ঋণের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি কোনো সম্পর্ক নেই। একান্ত নিজেদের ইচ্ছাতেই তেলের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ।
রাহুল আনন্দ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো সংকটময় পরিস্থিতি নেই। বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা বলতে গিয়ে রাহুল বলেন, ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি খুবই কম বাংলাদেশের। বৈদেশিক ঋণ তুলনামূলক অল্প। যা জিডিপির ১৪ শতাংশের মতো। সে কারণেই দেশটির ঋণখেলাপির পথে যাওয়ার ঝুঁকি কম। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আইএমএফ প্রস্তুত জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, তহবিলের বিষয়ে নিয়মমাফিক নীতিমালা ও প্রক্রিয়া অনুসারে আইএমএফের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রোগ্রাম ডিজাইন বিষয়ে আলোচনা করছেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে আইএমএফের বার্ষিক সভা হবে। সেখানে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
এর আগে গত জুলাই মাসে আইএমএফের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসেছিল। ৯ দিনের ওই সফরে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইএমএফের কাছ থেকে তিন কিস্তিতে সাড়ে ৪ বিলিয়ন (প্রতি কিস্তিতে দেড় বিলিয়ন) ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছিল।