সাত বছরে পাল্টে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র

ছিটমহল বিলুপ্তির পর দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে পিছিয়ে থাকা জনপদে এখন সন্ধ্যায় হলেই জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি। এখানকার বাসিন্দারা পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা। তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তাঘাট। এগিয়ে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয়েছে ক্লিনিক। বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্রই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। গত সাত বছরেই পাল্টে গেছে ছিটমহলগুলোর দৃশ্যপট।

রোববার (৩১ জুলাই) লালমনিরহাটে দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ছিটমহল বিনিময়ের সপ্তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে দুপুরে পাটগ্রামের বাঁশকাটা কমিউনিটি ক্লিনিকে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন, বিশেষ অতিথি ছিলেন পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বাবুল। আরও উপস্থিত ছিলেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা নজরুল ইসলাম ও বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি গোলাম মতিন রুমি।

jagonews24

একাধিক বিলুপ্ত ছিটমহল ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। সরকারি উদ্যোগে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে পাকা রাস্তা, ডিজিটাল সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, পুলিশ ফাঁড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েল, কমিউনিটি সেন্টার, সোলার প্যানেল দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, প্রতিবন্ধীদের জন্য করে দেওয়া হয়েছে ভাতার কার্ড। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৬টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিতরকুটি ছিটমহলের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী এসহাক আলী বলেন, জীবনের শেষ বয়সে ভোটার হয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি। বেঁচে থাকতে নতুন পরিচয় পেয়েছি, যা এক অন্যরকম আনন্দ।

jagonews24

পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল বাঁশকাটার বাসিন্দা ওমর আলী দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিটমহলের চিত্রও পাল্টে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নিজেদের পরিচয়টাও দিতে পারতাম না আমরা। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা সমস্যায় ভোগান্তির শেষ ছিল না। কিন্তু ছিটমহল বিলুপ্তের ফলে সেসব ভোগান্তির দিন ইতিহাস হয়ে গেছে। উন্নয়নের ছোঁয়া এখানকার বাসিন্দাদের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে।

লালমনিরহাটের ভিতরকুটি বাঁশপচাই ছিটমহলের সাবেক সভাপতি হারুনার রশিদ বলেন, সাত বছরে আমাদের ছিটমহলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিদুৎ, মসজিদ, মন্দির, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ রাস্তা, ব্রিজ কালভার্টের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি মোতাবেক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে। সেই সুবাদে উভয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলো দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগ হয়। এতে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করেন। চুক্তির সফল বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশের মানচিত্রে যোগ হয় ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি।

পাটগ্রাম উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাহবুব আলম জানান, গত সাত বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, তিনটি ব্রিজ, দুটি মসজিদ, একটি মন্দির, একটি শশান, কবরস্থানের বাউন্ডারি ওয়াল, কমিউনিটি সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে।

পাটগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে প্রায় ১ হাজার নলকূপ, দুইশো রিংওয়েল নলকূপ, আটশো স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে।

শিক্ষা অধিদপ্তর জানায়, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষায়িত ১ হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত ছিটমহলে চারটি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের ৮নং ভোটবাড়ী, ১৪নং লতামারী, ২১নং পানিশালা ও ১১৯নং বাঁশকাটা এলাকায় চার কক্ষবিশিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

jagonews24

স্থানীয় উদ্যোগে তিনটি নিম্ন মাধ্যমিক ও দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাঁশকাটা দয়ালটারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মোমিনপুর বাঁশকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবারেই এমপিওভুক্ত হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, এরই মধ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

২০১৫ সালে ছিটমহল বিলুপ্তির ফলে বন্দি জীবনের অবসান ঘটে ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। এর মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং ৫১টি ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের ১১১টির মধ্যে কুড়িগ্রামে ১২টি, লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি এবং নীলফামারী জেলায় রয়েছে চারটি বিলুপ্ত ছিটমহল। লালমনিরহাট জেলার ৫৯টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে সদর উপজেলায় দুটি, হাতিবান্ধা উপজেলায় দুটি ও বাকি ৫৫টির অবস্থান পাটগ্রাম উপজেলায়।