রাজরাজড়ার পাশা খেলায় জন্ম নেওয়া ভূমিগুলো ভারত বিভক্তিতে হয়ে পড়েছিল ছিটমহল নামের কারাগার। জুয়ার দানের প্রতিদান ছিল ভূমি। সেই ভূমির ভূমিপুত্ররাই হয়ে পড়েছিল ছিটমহলের আমৃত্যু বন্দি।
যাঁরা ছিটমহল সম্পর্কে জানেন না তাঁদের পক্ষে ছিটমহলের মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা অসম্ভব।
আজকের দিনে যাঁরা মূল ভূখণ্ডের অংশ হওয়া ছিটমহলে বেড়াতে যান, তাঁদের পক্ষে সেই কষ্ট অনুভব করা আরো অসম্ভব।
১৯৪৭ সালে করদ মিত্র রাজ্যগুলো ভারতীয় ইউনিয়ন বা পাকিস্তানে যোগ না দেওয়ায় তাদের মালিকানাধীন ভূখণ্ডগুলো তাদের অধীনেই থেকে যায়। kalerkanthoমালিকানা তাদের থাকলেও ভূমির চারদিকে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সীমানাগুলো। রাষ্ট্র পৃথক হওয়ায় ছিটমহলের মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা রহিত হয়ে যায়। এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের নাগরিকদের চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডা. বিধান চন্দ্র রায় কোচবিহার মহারাজার বন্ধু হওয়ায় তিনি বন্ধুকে বুঝিয়ে কোচবিহার রাজ্যকে ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত করতে সফল হন। প্রচার রয়েছে কোচবিহার রাজ্য ‘সি’ ক্যাটাগরির রাজ্যের মর্যাদা পাবে। ইতিহাসে সে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই। সে যাই হোক, কোচবিহার ভারতের অংশ হওয়ায় ভারতের অংশে পড়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা কোচবিহার মহারাজার মালিকানাধীন এলাকাগুলো। আবার রংপুরের মহারাজা পাকিস্তানে থেকে যাওয়ায় তাঁর মালিকানাধীন ভারতীয় সীমানার অভ্যন্তরের ভূমিগুলো পাকিস্তানের ছিটমহলের তকমা পায়। পাকিস্তান ও ভারতের টানাপড়েনের সবচেয়ে বেশি ছাপ পড়ত ছিটমহলগুলোর মানুষের জীবনে। তারা নিজ বাসভূমে পরাধীন হয়ে পড়ে। এ যন্ত্রণা ছিটমহলবাসীকে প্রায় সাত দশক বইতে হয়। নেহরু-নূন থেকে শুরু হয়ে দুই দেশের বেশ কিছু সরকার বিষয়টি আলোচনার টেবিলে নিলেও কার্যত সফলতা পায়নি ছিটমহল বিনিময়।
একাত্তরে বাংলাদেশ জন্মের পেছনে ভারতীয় ছিটমহলের নাগরিকদেরও অনেক অবদান ছিল। পাটগ্রাম ও কুড়িগ্রাম অঞ্চলের অনেক ছিটমহলের নাগরিক শুধু সহযোগিতাই করেননি, কেউ কেউ বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। একাত্তরে বেশ কিছু ছিটমহল মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন সেখানে।
ছিটমহল মানেই কারাগার ছিল। শুধু তা-ই নয়, সেখানে নাগরিকজীবন বলতে কোনো কিছুই ছিল না। হত্যা করলেও তার বিচার ছিল না। থানা ছিল না। বিচারালয় ছিল না। জমির বৈধ ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ ছিল না। বৈধ স্থানীয় সরকার ছিল না। দু-একটি কওমি মাদরাসা ছাড়া সেখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ছিল না। অর্থাৎ ছিটমহলে একজন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তা করতে রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থেই ব্যর্থ ছিল।
যাঁরা হজে গেছেন বা গয়া-কাশিতে গেছেন তাঁরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় লুকিয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকের পরিচয় তৈরি করে পুণ্যস্থানগুলোতে গিয়েছিলেন। হাজারো অসুস্থ ছিটমহলবাসী জাতীয় পরিচয় লুকিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। হাজারো জননী প্রসবযন্ত্রণা নিয়ে ভিন্ন দেশের হাসপাতালে স্বামীর নাম ও ঠিকানা লুকিয়ে ভর্তি হয়েছেন। কেউ কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশের ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।
একটি ঘটনা না বললেই নয়, ছিটমহল বিনিময়ের জন্য আন্দোলন গড়ে ওঠার সময় ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি ছিটমহল মশালডাঙ্গায় একজন প্রসূতি প্রসব বেদনা নিয়ে দিনহাটা হাসপাতালে যান। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশি ছিটমহলে জেনে তাঁকে সেখানকার কর্তৃপক্ষ ভর্তি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিষয়টি জানতে পেরে ছিটমহল আন্দোলনের নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত, কলকাতার রক্তিম দাস, কোচবিহারের মঈনুদ্দিন চিশতিসহ গণমাধ্যম ব্যক্তিরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ জেলা ও মহকুমা প্রশাসনে তোলপাড় করে তোলেন। আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকায়ও খবর প্রকাশিত হলে টনক নড়ে হাসপাতাল প্রশাসনের। ওই মানবিক আন্দোলনের ফলে হাসপাতালে জেহাদের মা ছিটমহলের পরিচয় দিয়েই ভর্তি হন। সেখানেই জেহাদের জন্ম হয়। সে অর্থে জেহাদই হচ্ছে প্রথম শিশু, যে অনুমোদনক্রমে ভারতীয় হাসপাতালে জন্ম নিয়েছিল। দীপ্তিমানরা এ জন্য শিশুটির নাম রেখেছিলেন জেহাদ। ছিটমহল বিনিময়ের দিন ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই দিবাগত মধ্যরাতে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের পক্ষে ভারতীয় অংশের মশালডাঙ্গার কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ভারত উপমহাদেশের সব মিডিয়ার প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। জেনেভা থেকে ছুটে এসেছিলেন ছিটমহল নিয়ে কাজ করা গবেষক ড. অনুরাধা সেন মুখার্জি। সে অনুষ্ঠানে জেহাদ, তার মা-বাবা, সাংবাদিক মঈনুদ্দিন চিশতি এবং তদানীন্তন জেলা শাসককে অনুষ্ঠান মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। সেদিনের উপস্থাপনাগুলো প্রাণ ছুঁয়ে গিয়েছিল।
এপারের আয়োজন ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু দাশিয়ারছড়ায়। সেখানে সমবেত হয়েছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যম। রাত থেকে শুরু হয়ে পরদিন সন্ধ্যা অবধি গড়ায় সে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আমিসহ দীপ্তিমান সেনগুপ্ত, অনুরাধা সেন মুখার্জি দাশিয়ারছড়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিই। লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়েও আনন্দ আয়োজন ছিল ছিটমহল বিনিময়ে।
আমরা যাঁরা ছিটমহল নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম তাঁরা নতুন আইন করে সমাধান করতে বলিনি। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা প্রণীত ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট, যা ভারতীয় রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের সংসদে অনুমোদন না হওয়ায় আটকে ছিল সেই চুক্তির রেটিফিকেশন ও চুক্তির বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের সরকারগুলো ছিটমহল বিনিময় না করে উল্টো চুক্তিকে দেশ বিক্রির ও গোলামির চুক্তি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। স্বয়ং জেনারেল এরশাদ সংসদে বক্তব্য দিয়ে সে কথা স্বীকার করে পাপ স্খলনের চেষ্টা করেছিলেন।
সে সময় পাকিস্তানের আদর্শধারী, অনুগত রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতারা মাঠে-ময়দানে ভারতকে টার্গেট বানিয়ে ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনীতি কায়েম করেন। সংগত কারণে ভারতীয় সরকার ও রাজনীতিকরা ছিটমহল বিনিময় থেকে পিছিয়ে যায়। তাদের নির্বাচিত-অনির্বাচিত রাজনীতিকরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পঁচাত্তরের পরে অসাংবিধানিক ও গায়ের জোরে গঠিত সরকারগুলোও ছিটমহল বিনিময়ে আন্তরিক ছিল না। ছিটমহল নিয়ে বাংলাদেশের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালেই সম্পন্ন করেছিলেন সংসদে রেটিফাইয়ের মাধ্যমে। আমাদের ছড়ানো অপপ্রচার ভ্রান্ত রাজনীতির জালে আটকে যায় ছিটমহল। ভারতও পিছিয়ে যায় রেটিফাই করা থেকে। প্রণীত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টির নিষ্পত্তি টানেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর আন্তরিকতায় ভারতীয় সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদি সম্মত হন নিষ্পত্তির পথে হাঁটতে। যা আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর হয় ১ আগস্ট ২০১৫। ভারত তাদের সব রাজনীতিককে এক করতে পেরেছিল। বিশেষত নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈকে এক করতে পেরেছিলেন, যাঁরা একসময় ছিটমহল বিনিময়ে বিপুল বিরোধিতা করেছিলেন। অতঃপর ভারতীয় সংসদে চুক্তির ৪১ বছর পর সর্বসম্মতভাবে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি রেটিফাইড হয়।
ছিটমহল বিনিময় একটি অনন্য অর্জন। বিনা রক্তে ভূমির বদল। বন্দি মানুষগুলোর নাগরিক অধিকার ছিল না। এই বিনিময় তাঁদের সেই মর্যাদা প্রদান করে। মোট জমি ২৪ হাজার একর। বিনিময়ে বাংলাদেশ ১৭ হাজার আর ভারত সাত হাজার একর জমি রক্তক্ষরণ ছাড়াই লাভ করে। ভারত জমিতে ছাড় দিলেও বাংলাদেশকে জনসংখ্যা বেশি গ্রহণ করতে হয়। এখানে লাভ-লোকসানের হিসাবের চেয়ে বড় বিষয় ছিল বন্দি মানুষগুলোর মুক্তি এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার। মূল ভূখণ্ডে একীভূত হতে ছিটমহলের নাগরিকদের পছন্দক্রমকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। জোরজবরদস্তি ছিল না। তাঁদের একীভূত করতে এক ফোঁটা রক্তও ঝরেনি। বিপুল জনগোষ্ঠী ও ভূমির বিনিময়ের শান্তিপূর্ণ বাস্তবায়ন দুনিয়াজুড়ে নতুন উদাহরণ। এ জন্য দুনিয়ার সেরা সম্মাননা প্রাপ্য ছিল দুই দেশের সরকারপ্রধানের।
ছিটমহল আজ গবেষণার বিষয়। জাদুঘরে দেখার বিষয়। আজকের দিনে ছিটমহলে গেলে মানুষের হাসিমুখ দেখে বোঝা কঠিন একদিন তাঁরা বন্দি ছিলেন, মলিন ছিলেন। আজ ছিটমহলের নাগরিকরা মূলধারার ও মূল ভূমির নাগরিকদের সঙ্গে সমান সুযোগ পাচ্ছে। প্রথম স্মার্ট কার্ড বিতরণ, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, শতভাগ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় কায়েম হয়েছে। বাংলাদেশের জনবহুল ছিটমহলগুলোতে বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাই স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সদ্যোঘোষিত এমপিওতে ছিটমহলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। ছিটমহলের শিক্ষিত নাগরিকরা ভারত/বাংলাদেশ যেখান থেকেই লুকোচুরি করে পড়ালেখা করে থাকুন না কেন, তাঁদের সনদ মূল্যায়িত হচ্ছে। ছিটমহলের শিক্ষিতরা সরকারি-বেসরকারি চাকরি, পুলিশ, আর্মি সব জায়গায়ই যোগ্যতা থাকলে নির্বাচিত হচ্ছেন। জমিজিরাতের হাল রেকর্ড হয়েছে তাঁদের নামে। এখন জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছেন। সরকারি ব্যয়ে মসজিদ ও মন্দির নির্মিত হয়েছে সেখানে, এমনকি আইটি শিক্ষার জন্য বিশেষ ল্যাবও হয়েছে। সেখানে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, নাগরিক হিসেবে সবাই আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন, যা ছিল কল্পনার বাইরে।
ছিটমহলের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, এটি ছিটমহলের শত্রুরাও স্বীকার করবেন আশা করি। অবশ্য এটিও ঠিক, বাংলাদেশের আওতায় আসা ১১১টি ছিটমহলে যে পরিমাণে উন্নয়ন হয়েছে সে অনুপাতে ভারতের অংশে যাওয়া ৫১টি ছিটমহলের উন্নয়ন দৃষ্টিগোচর নয়। যাঁরা অনেক আগ্রহ নিয়ে অপশন দিয়ে ভারতে গেছেন তাঁদের অবস্থা ও কথাবার্তা শুনলে অন্তত তাই মনে হয়। এখনো তাঁরা মূলধারার সঙ্গে মিলতে পারেননি। তাঁদের জমিজিরাতের মালিকানার কাগজপত্রের এখনো ফায়সালা হয়নি। যাঁরা আগে থেকে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন তাঁদের চালু করা সেই ব্যবসার কাগজ সংকটে অনেকেই আছেন। যিনি ৪০ বছর আগে থেকে বাংলাদেশের ছিটমহলে করাতকল দিয়ে জীবন নির্বাহ করতেন, এখন তাঁর কাছে করাতকলের অনুমোদনের কাগজ চাইছে। আমাদের দেশে ৩০ বছরের পুরনো কাগজ অফিস-আদালতে অত্যাবশ্যকীয় না হলে সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে তাঁরা কাগজের অভাবে বিপদে আছেন। নকশাল আন্দোলনের সময় কোচবিহারের রেকর্ডরুম পুড়ে গেলে জমির মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতায় বাংলাদেশের অংশে থাকা ছিটমহলের অনেক নাগরিকের সমস্যা হয়েছে। যাঁরা অপশন দিয়ে ভারতে গেছেন, যাওয়ার সময় তাঁরা জেলা প্রশাসকের হাওলায় জমি রেখে গেছেন। সেসব জমি হাল রেকর্ডে খাস খতিয়ানভুক্ত হয়েছে। এই জমি তাঁরা চাইলেও পাওয়া কঠিন। বিক্রি বা দান করতেও পারবেন না। কারণ হাল রেকর্ড খাস খতিয়ানভুক্ত। এ এক জটিল অবস্থা। ইচ্ছা করলেও সেসব জমির হাতবদল সম্ভব হচ্ছে না।
যাঁরা ভারতে গেছেন তাঁদের অনেকেই অপশন বদলে নিজ ভিটায় ফিরতে চাইলেও তা আর হচ্ছে না। আবার এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ছিটমহলের অধিবাসী জনগণনার সময় ভারতের নানা রাজ্যে কাজকর্মে ছিলেন, জনগণনায় নাম তুলতে পারেননি, অপশন দিতে পারেননি, তাঁদের অনেকেই ভারতে অবৈধ হয়ে পড়েছেন; যদিও তাঁরা ভারতীয় ছিটমহলেই জন্ম নিয়েছিলেন অর্থাৎ ডমিসাইলড বাই অরিজিন। এখন ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশে ফিরতে পারছেন না। কারণ দুই দেশের প্রণীত নাগরিকপঞ্জিতে তাঁদের নাম নেই। এ রকম বেশ কিছু ব্যক্তি ভারতের নানা কারাগারে আটক আছেন। অনেকেই পরিচয় গোপন করে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করছেন। তাঁদের বিষয়ে দুই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে আসা উচিত। জন্মসূত্রে একজন ব্যক্তি শুধু অপশন না দেওয়ার কারণে নিজ দেশে বাতিল নাগরিক হতে পারেন না। ডমিসাইলড বাই অরিজিন হিসেবে তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মুক্ত স্বাধীন থাকবেন। ছিটমহল একীভূত হওয়ার আগে থেকে যেসব ব্যক্তি ছিটমহলে ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ন্যাচারাল রিকগনেশনের আওতায় বৈধ হিসেবে বিবেচনা করা। ছিটমহলে ব্রিটিশ, ভারত ও পাকিস্তান যুগের জমির কাগজ প্রাপ্তি সহজ করা।
যেখানে ছিটমহলের জমির পাকা রেকর্ড হয়েছে, তাদের জমি রেকর্ডের অ্যাপিলেট অথরিটি তৈরি করা।
পাশাপাশি এটিও নিশ্চিত করা—সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার নামে বাণিজ্য যাতে না হয়। একই সঙ্গে সেখানে যাতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো ধরনের মনোপলি গড়ে তুলতে না পারে, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
ছিটমহলের মানুষ যাতে বাংলাদেশের সব মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গারাতি, দাশিয়ারছড়াসহ বেশ কয়েকটি সাবেক ছিটমহলের মানুষ এবং পরিণতি অনুভব না করা কেউ কেউ শুরু থেকেই সচেষ্ট সাবেক ছিটমহলকে ধরে পৃথক ইউনিয়ন করার জন্য। এটি হলে ছিটমহলের মানুষের কাছে সাবেক টেরিটরি অজান্তেই পৃথক স্টেট হিসেবে থেকে যাবে। নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার একটা স্পেস রাষ্ট্র করে দেবে, যা সুদূরে তাদের জন্য অনিষ্টকর হবে। মেইনল্যান্ডের মানুষের সঙ্গে একটা মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংসৃ্কতির গ্যাপ তৈরি থাকবে। আমাদের প্রয়োজন তারা ছিটমহল নয়, সমগ্র দেশকে প্রতিনিধিত্ব করুক।
লেখক : এস এম আব্রাহাম লিংকন
একুশে পদকপ্রাপ্ত আইনজীবী ও রাজনীতিক