স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার জনসংখ্যা গণনা হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৮১ সালে হয় দ্বিতীয়বার জনসংখ্যা গণনা। এরপর ১০ বছর পরপর ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালে জনসংখ্যা গোনা হয়। এসব শুমারির ফল পেতে লেগেছে ছয় থেকে সাত মাস। সবচেয়ে কম, চার মাস সময় লেগেছিল ২০১১ সালে। তবে এবার সব চিত্র বদলে গেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে মাত্র ২৯ দিনেই মিলেছে জনসংখ্যার হিসাব। একে ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম সুফল হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, আগে প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার পর হাতে কলমে সেগুলো হিসাব করা হতো। ফলে দীর্ঘসময় ধরে শুমারির ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। অন্যদিকে এবার জনসংখ্যা গণনার সঙ্গে সঙ্গেই তার ফল কেন্দ্রীয় সার্ভারে চলে এসেছে। এরপর তা বিশুদ্ধ করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
দেশে এবার শুমারির কাজ শুরু হয় ১৫ জুন। ২১ জুন মধ্যরাতে তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে হঠাৎ বন্যায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সিলেট, সুনামগঞ্জসহ কয়েকটি জেলা। এ কারণে বন্যাকবলিত সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোনায় তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে ২৮ জুন পর্যন্ত। এরপর শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত বুধবার (২৭ জুলাই)।
বিবিএস জানায়, ১৯৭৪ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মোট চারটি শুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেসময় জনশুমারির নাম ছিল আদমশুমারি। পরিসংখ্যান আইন-২০১৩ অনুযায়ী ‘আদমশুমারি’ নাম বদলে ‘জনশুমারি’ করা হয়।
শুমারির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে এলাকাভিত্তিক জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম ও জিও কোড সমন্বয় করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রস্তুত ও শুমারিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিটাল ম্যাপ ব্যবহার করে প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার কর্মী নির্ধারিত এলাকার তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ডিজিটাল এ শুমারি বাস্তবায়নে ব্যবহার হয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব।
মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে ব্যবহৃত ট্যাবসমূহ মোবাইল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট ফটওয়্যার ব্যবহার করে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এছাড়া সংগৃহীত তথ্য সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে কালিয়াকৈরে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের টায়ার-আইভি (iV) সিকিউরিটি সমৃদ্ধ ডেটা-সেন্টার ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন বলেন, আগে শুমারির তথ্য পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। এবার সবার সহযোগিতায় আমরা মাত্র ২৯ দিনেই ফল প্রকাশ করেতে পেরেছি। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছে। তারই ছোঁয়া লেগেছে জনশুমারিতে। যে কারণে এত দ্রুত ফল প্রকাশ করতে পেরেছি। প্রথম ডিজিটাল জনশুমারিতে ডিজিটাল ডিভাইস ‘ট্যাব’ ব্যবহার করে কম্পিউটার অ্যাসিসটেড পারসোনাল ইন্টারভিউইং (ক্যাপি) পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
বিবিএস জানায়, মাঠ সার্ভারে আসার আগ পর্যন্ত সংগৃহীত সব তথ্য-উপাত্ত গোপন ছিল। এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা গেছে। এছাড়া একটি ওয়েবভিত্তিক ইন্টিগ্রেটেড সেনসাস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুমারির যাবতীয় কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। তাছাড়া এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম সব সময় মনিটর করা হয়েছে। মাঠের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম রিয়েল টাইম মনিটরিংয়ের পাশাপাশি তথ্যের গতিবিধি সরাসরি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছিল।
এসব নিয়ে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন বলেন, শুমারির নামই ডিজিটাল শুমারি। ক্যাপি সিস্টেমের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের বিবিএস নকরুমে সরাসরি তথ্য চলে এসেছে। আগে এটা হাতে করা হতো। প্রতিদিনের তথ্য প্রতিদিন পেয়েছি। এই প্রক্রিয়ায় শুমারি করার কারণে দ্রুত রেজাল্ট পেয়েছি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানায়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে ১০ বছরের আগেই দেশের জনসংখ্যার তথ্য দেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। কারণ এবারই প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনশুমারি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। একটি ওয়েবভিত্তিক ইনটিগ্রেটেড সেনসাস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইসিএমএস) প্রস্তুতসহ জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমে (জিআইএস) গণনা এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের কন্ট্রোল ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রযুক্তির কল্যাণে দ্রুত জনশুমারির ফলাফল দিতে পেরেছি। আগে বাড়ি বাড়ি কাগজে কলমে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। এতে অনেক বানান ভুল থাকতো। এবার লেখার কিছু ছিল না। জনশুমারি বিশুদ্ধ ছিল। আগে তথ্য আসতে সময় লাগতো, অনেক সময় বৃষ্টির পানিতে তথ্য মুছে যেত।
‘বিবিএস সচিব প্রকল্প পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে চমৎকার একটা টিম তৈরি করেছেন। ডিজিটাল শুমারির ফলাফল কিন্তু অনেক আগেই জানতাম। কারণ একজন গণনাকারী কাউকে গণনা করার সঙ্গে সঙ্গে রেজাল্ট আমাদের হাতে এসেছে। কিছু সময় নিয়েছি এটাকে আরও বিশুদ্ধ করতে। সচিব ও আমরা সব সময় মনিটর করেছি প্রতিটি বিষয়। কয়টা জেলায়, কারা কাজ করছে সব দেখেছি, সব সময়। সবাই দক্ষ ছিল প্রযুক্তির ব্যবহারও দারুণ ছিল। মাঠের সহায়তা ভালো পেয়েছি। সবাই মনোযোগ সহকারে কাজটি করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়েছি। এটাকে ব্যবহার করে সামনে যাতে দ্রুত শুমারির রেজাল্ট দিতে পারি সে বিষয়ে কাজ করা হবে। যাতে করে এত টাকা ব্যয় না করে প্রতি সপ্তাহে দেশের মানুষের তথ্য পেতে পারি। আমরা দেশীয় ট্যাবে শুমারি করেছি। এটা আমাদের বড় অর্জন। সামনে জনশুমারির তথ্য আরও দ্রুত পাবো। প্রতি মুহূর্তের খবর জানতে খোঁচা মারলে যন্ত্র বলে দেবে দেশের মানুষ কত? মানুষের সঠিক তথ্য না পেলে কোনো পরিকল্পনাই বিশুদ্ধভাবে করা সম্ভব নয়।