এ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে একের পর এক সুখবর মিলছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে ২১ জেলার ভাগ্য খুলে দিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রারও পথ খুলে দিয়েছে এই সেতু। এরই ধারাবাহিকতায় এবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অচিরেই চালু হতে যাচ্ছে বন্দরের নতুন কনটেইনার টার্মিনাল। এই টার্মিনালে সারা দেশের আমদানি-রপ্তানিকারকদের পণ্য হ্যান্ডলিং হবে। স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য খুব গুরুত্ব বহন করে এই প্রকল্প।
গত সাড়ে ১৪ বছরে সমুদ্রগামী জাহাজের নতুন কোনো টার্মিনাল নির্মাণ হয়নি। সর্বশেষ টার্মিনালটি নির্মাণ হয় ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটির পাশে। এটির নাম নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। এই টার্মিনালের নির্মাণের দীর্ঘসময় পর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালুর খবর ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের জন্য বড় সুখবর।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বৈদেশিক বাণিজ্য ভাঙছে। বন্দর দিয়ে কনটেইনার ও পণ্য পরিবহন আড়াই গুণ বেড়েছে। এসবই পরিবহন হয়েছে আগের তিনটি টার্মিনাল ব্যবহার করে। তবে এ সময়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বন্দরের বহরে যোগ হয়েছে। নতুন নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য নতুন জেটি ছিল না এত দিন। নতুন টার্মিনাল চালু হতে যাওয়ায় সেই ঘাটতিও এবার পূরণ হলো।
নতুন টার্মিনালটি নির্মাণ হয়েছে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক এবং চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের মাঝামাঝি। কর্ণফুলী নদীর তীরে এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে। আলাদা করে ডলফিন অয়েল জেটি আছে, যেখানে তেলবাহী জাহাজ থেকে তেল খালাস করা যাবে। নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ইয়ার্ড ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি এখনো শেষ হয়নি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রথম কোনো টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে দেশে। এই প্রকল্পে যুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও প্রকৌশলীদের সিংহভাগই এ দেশের। এতে এ দেশের প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া গেল।
বন্দরে এখন তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালসহ এই সংখ্যা চারটিতে উন্নীত হবে। এই টার্মিনালে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে মূলত কর্ণফুলীর ভাটিতে নির্মাণ হওয়ায়। অন্য টার্মিনালগুলোর চেয়ে কম সময়ে সাগর থেকে জাহাজ ভেড়ানো যাবে এই টার্মিনালে। পাড়ি দিতে হবে মাত্র ছয় থেকে আট কিলোমিটার পথ। অন্য টার্মিনালে ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। এই টার্মিনালের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অন্য টার্মিনালের চেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ানো। বন্দরের অন্য তিনটি টার্মিনালে এখন সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যায়। নতুন টার্মিনালে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে।
সামনে দিন দিন উত্পাদনের পরিসর বাড়বে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্য সামনে বাড়বে। এজন্য নতুন টার্মিনালের খুবই প্রয়োজন ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে বাল্ক জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কার্যক্রমের মাধ্যমে টার্মিনালটির কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের যন্ত্রপাতি যুক্ত হলে কনটেইনার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হবে।
যতটুকু জেনেছি, নতুন টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধাদি যুক্ত করতে সময় লাগবে। টার্মিনাল পরিচালনার জন্য এখনো অপারেটর নিয়োগ হয়নি। বন্দরের উচিত হবে, অপারেটর নিয়োগের আগে বন্দরের নিয়োগ করা অপারেটর দিয়ে দ্রুত কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু করে দেওয়া। বন্দরের সেই সক্ষমতা আছে। যন্ত্রপাতি যুক্ত হওয়ার আগে এই টার্মিনালে বাল্ক ও ব্রেক বাল্ক জাহাজ হ্যান্ডলিং হলেও সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে জেনারেল কার্গো বার্থে কনটেইনার জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। মূল জেটিতে কনটেইনার জাহাজের কোটা বাড়িয়ে পতেঙ্গা টার্মিনালে খোলা জাহাজের প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।
এই টার্মিনালে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। আগের তিনটি টার্মিনালে একসঙ্গে ১১-১২টি জাহাজ ভেড়ানো হতো। সব মিলিয়ে এখন একসঙ্গে ১৪-১৫টি জাহাজ থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। এর অর্থ সামনে দুই-তিন বছর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাপ থাকলেও সমস্যা হবে না। জাহাজ আউটারে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।
এই টার্মিনাল চালু হলে সবচেয়ে বড় উপকার হবে রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল আমদানিতে বাড়তি কোনো সময় লাগবে না। আর রপ্তানি বাড়লেও সমস্যা হবে না। টার্মিনালটি যেহেতু বন্দর থেকে দূরে সেজন্য এই টার্মিনালের পণ্য আউটার রিং রোড হয়ে পরিবহনে জোর দেওয়া উচিত; না হলে শহরে যানজট হবে। এলসিএল কনটেইনারে রপ্তানির কাঁচামাল থাকে। সেটি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আবার ঢাকার কমলাপুর কনটেইনার ডিপোতে যেসব কনটেইনার নেওয়া হবে, সেগুলো কীভাবে ব্যবস্হাপনা হবে সেটিও ভাবা দরকার। যেহেতু এই টার্মিনালের সঙ্গে রেললাইন নেই, তাহলে কমলাপুরগামী কনটেইনার নিতে হলে আবার চট্টগ্রাম বন্দরের মূল স্হাপনায় নিয়ে আসতে হবে। সেটা কীভাবে করা হবে, সেই পরিকল্পনাও থাকা উচিত।
টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন চাপ সামাল দেওয়ার জন্য। কয়েক বছর আমাদের কনটেইনার হ্যান্ডলিং নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। তবে এখানে থেমে থাকলে চলবে না। বন্দর কর্তৃপক্ষের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা চাই আমরা। এজন্য বে-টার্মিনাল নির্মাণে জোর দিতে হবে। এখনই জোর দেওয়া না হলে তিন-চার বছর পর আবারও কনটেইনার হ্যান্ডলিং নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে।
লেখক: খায়রুল আলম সুজন
সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন