ভূসম্পদ উপগ্রহের ৫০ বছর, আমাদের আগামীর ভাবনা

২৩ জুলাই ১৯৭২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র ভূসম্পদ অনুসন্ধানে প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে, নাম ছিল আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট সংক্ষেপে ‘ইআরটিএস’ ও পরে নামটি বদলিয়ে ‘ল্যান্ডস্যাট’ রাখা হয়। এ পর্যন্ত এ সিরিজের ৯টি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এ উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ভূপর্যবেক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহারে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে, পরবর্তী সময়ে যার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে এবং ভূসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।

তবে বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে ৪ অক্টোবর ১৯৫৭ তারিখে ‘স্পুত্নিক-১’ নামে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ও ১২ এপ্রিল ১৯৬১ তারিখে প্রথম মানুষ প্রেরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫০ সালের শেষ দিকে ‘করোনা’ উপগ্রহ কর্মসূচি শুরু করে উৎক্ষিপ্ত হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯। প্রথম উপগ্রহগুলো কোনো ইমেজ তৈরি করতে না পারলেও নবমটি ১৯৬০ সালে ১৮ আগস্ট সফল হয় ও মহাকাশ থেকে ফিল্মসহ ফিরে আসার মাধ্যমে মহাকাশ থেকে ইমেজ আহরণ যুগের শুরু, সবশেষ ‘করোনা’ ইমেজ আহরিত হয় ৩১ মে ১৯৭২। কিন্তু এগুলো ছিল তখন সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য, বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯৯৫ সালে ডিক্লাসিফাইড ঘোষণা করা হয়। যাহোক, এগুলোর মূল্য অনেক হলেও প্রথম যুগের এ উপগ্রহগুলো নিখুঁত ছিল না এবং একটা ক্যাপসুলের মধ্য দিয়ে প্যারাসুটের সাহায্যে উপগ্রহ থেকে ইমেজ পৃথিবীতে পাঠাতে কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ লাগত। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশে মানুষ প্রেরণের কর্মসূচি চালায়—ফলস্বরূপ ১৯৬৯-১৯৭২ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র অ্যাপোলো সিরিজের উপগ্রহের দ্বারা ১২ জন মহাকাশচারীকে চাঁদে প্রেরণে সক্ষম হয়।

ভূসম্পদ উপগ্রহ সম্পর্কে বলার আগে কৃত্রিম উপগ্রহের ধরন বিষয়ে একটু ধারণা দেওয়া যাক। পৃথিবী সাপেক্ষে উপগ্রহের অবস্থান বিবেচনায় উপগ্রহ দুই ধরনের মেরু আবর্তক সূর্যালয় উপগ্রহ (পোলার অরবিটিং সান-সিনক্রোনাস স্যাটেলাইট) এবং ভূস্থির উপগ্রহ (জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট)। মেরু আবর্তক উপগ্রহগুলো মেরু বা প্রায় মেরু বরাবর ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭০০-৯০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থেকে উত্তর-দক্ষিণে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। ভূসম্পদ, সমুদ্র সম্পদ বা পরিবেশ পর্যবেক্ষণে এ ধরনের উপগ্রহ ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে ভূস্থির উপগ্রহগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় থেকে নিরক্ষীয় রেখা বরাবর অবস্থান করে পশ্চিম থেকে পূর্বে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, পৃথিবীর সঙ্গে ঐ উপগ্রহের কোনো আপেক্ষিক গতি না থাকায় তখন পৃথিবী থেকে তাকে স্থির মনে হয়। টেলিযোগাযোগ ও টেলিভিশন সম্প্রচার এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য এ ধরনের উপগ্রহ ব্যবহৃত হয়। আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু-১’ উপগ্রহটি একটি ভূস্থির উপগ্রহ। ইমেজ আহরণে শক্তির উৎস বিবেচনায় উপগ্রহগুলো আবার দুই ধরনের—সক্রিয় (ল্যান্ডস্যাট, স্পট) ও অক্রিয় (রাডারস্যাট), প্রথমটিতে সূর্যালোক থেকে ও দ্বিতীয়টিতে নিজস্ব উৎসের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়।

‘অবারিত আকাশ’ নীতির আওতায় ভূসম্পদের নিয়মানুগ, পুনরাবৃত্তিমূলক, মধ্যম রেজুল্যুশন, বহুবিধ ভিত্তিতে উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে ‘ল্যান্ডস্যাট’ কর্মসূচি শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স ১৯৮৬ সালে ‘স্পট-১’ ও ভারত ১৯৮৮ সালে ‘আইআরএস’ নামের ভূসম্পদ উপগ্রহসমূহ প্রেরণ করে। তবে সমুদ্র এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৮ সালে রাডার প্রযুক্তিসংবলিত ‘সিস্যাট’ নামে একটি উপগ্রহ প্রেরণ করে, যা ১০৬ দিন পরে অকার্যকর হয়ে যায়। এসবই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হলেও বেসরকারি পর্যায়েও উপগ্রহ (যেমন:‘আইকোনস’, ‘কুইকবার্ড’, ‘অরবভিউ’, ‘রপিডআই’) প্রেরণ শুরু হয়ে যায়, যা অব্যাহত আছে, যাকে মহাকাশ ব্যবসায় বলা যেতে পারে। ভূসম্পদ উপগ্রহের ক্ষেত্রে বর্তমানে আধিপত্যশীল দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিভুক্ত দেশসমূহ, কানাডা, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ইত্যাদি। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির এক হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার ১০০টি উপগ্রহ প্রেরণ করা হয়েছে, যার ৮ হাজার ৪১০টি মহাকাশে রয়ে গেছে, তার মধ্যে ৫ হাজার ৮০০টি এখনো কার্যকর রয়েছে।

দ্য কনভারসেশন ডটকমের তথ্যমতে, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত পৃথিবীর কক্ষপথে উপগ্রহের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৯৪১টি। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, ১৯৫৭ সালে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ শুরু হলেও প্রতি বছর তার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এ বৃদ্ধির কারণ মূলত দুটি, মহাকাশে উপগ্রহ প্রেরণ সহজ হওয়া এবং উপগ্রহের আকার ছোট হওয়ায় রকেটগুলো একসঙ্গে ও সহজে আগের চেয়ে বেশি উপগ্রহ বহন করতে পারার সক্ষমতা অর্জন। স্পুত্নিকের ওজন ছিল ৮৩ কিলোগ্রাম, ‘ল্যান্ডস্যাট’-এর বিভিন্ন উপগ্রহের ওজন ৮১৫ থেকে ২ হাজার ৭১১ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। তবে ছোট উপগ্রহগুলির ওজন সাধারণত ৬০০ কিলোগ্রামের কম হয়ে থাকে এবং মহাকাশ স্টেশনের ওজন হলো ৪১৯ টন। এদিকে আশঙ্কার ব্যাপার হলো ভবিষ্যতে আমরা মহাকাশে উপগ্রহজাত জঞ্জালের হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছি কি?

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই ‘ইআরটিএস/ল্যান্ডস্যাট’ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীগণ ও বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের দুই জন ভূতত্ত্ববিদ এতে ছিলেন। শুরুতে উপকূলীয় এলাকার ও পরে কুমিল্লা অঞ্চলে ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রায়নে এ উপগ্রহচিত্র ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময়ে ভূতাত্ত্বিক ও ভূমিরূপ মানচিত্রায়ন, কৃষি, বন জরিপ, মৎস্য, জলাশয় জরিপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বিশেষত ঘূর্ণিঝড়, বন্যা), পরিবেশ, নগর ভূতত্ত্ব ও পরিকল্পনা, নদীর মরফোলজি ও গতিপথ পর্যবেক্ষণ, ভূপ্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে উপগ্রহ উপাত্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে প্রযুক্তিগত, ডিজিটাল ইমেজ লভ্যতায়, উপাত্ত বিশ্লেষণ ক্ষমতায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ইতিমধ্যে ইমেজের স্থানিক রেজুল্যুশন (৮০ মিটার থেকে ১ মিটারের নিচে) ও অসংখ্য সংকীর্ণ ও সংলগ্ন বর্ণালিগত রেজুল্যুশনে (বহু ব্যান্ড থেকে শত শত ব্যান্ডে) উন্নতি হয়েছে।

আগামী দিনগুলিতে ভূতত্ত্ব ও ভূমিরূপ, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানি, পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম, পানি, বনসম্পদ, যোগাযোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন সূচক, জনস্বাস্থ্য, নগর ও গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা, উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রবিজ্ঞান ও সমুদ্রসম্পদ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ, ভূ-আচ্ছাদন ও ভূমি ব্যবহার, প্রত্নতত্ত্ব, শিক্ষা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে ব্যাপক ও সফল ব্যবহার হতে পারে। তদুপরি স্থানীয় আবহাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ধরন ও মাত্রা, পৃথিবীর পরিবেশের ওপর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট ঘটনার প্রভাব পর্যবেক্ষণ, অনুধাবন ও মডেলিং বা বহুবিধ উপগ্রহ উপাত্ত ব্যবহার করে পৃথিবীর আরো গভীরে দেখা ইত্যাদির মতো গবেষণা হতে পারে।

এক অনন্য ভূতাত্ত্বিক-টেকটোনিক ও ভৌগোলিক পরিবেশে ছোট এ দেশের অবস্থান যেখানে বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাস, যারা আবার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছেন; জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও ভূসম্পদের যথাযথ ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতে নিজেদের সম্পদ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। তদুপরি আমাদের সমুদ্র এলাকা এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে ভূসম্পদ উপগ্রহ প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দরকার। উন্নত অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়ে তা ধরে রাখতে হলে আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও উন্নত হওয়া দরকার।

আরেকটি কথা বলা দরকার যে, এভাবে লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গে সংস্পর্শ ছাড়াই দূর থেকে উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতিকে বলা হয় রিমোট সেন্সিং বা দূর অনুধাবন, প্রথম প্রজন্মে বিমান থেকে ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তোলা হতো, যা অবশ্য এখনো করা হলেও এতে প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে, দ্বিতীয় প্রজন্মে এসেছে উপগ্রহের সাহায্যে ডিজিটাল ইমেজ সংগ্রহ এবং তৃতীয় প্রজন্মে যোগ হয়েছে ড্রোনের ব্যবহার। তাই অতি দ্রুততায় অগ্রসরমাণ দূর অনুধাবন প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে খেই হারানোর সম্ভাবনা আছে, কাজেই ভবিষ্যতে নিজস্ব ভূসম্পদ উপগ্রহ ব্যবহারের দৃঢ়প্রত্যয়সহ আমাদের প্রকৌশলী-প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী-গবেষক, বিভিন্ন ব্যবহারকারী, পরিকল্পনাবিদ, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট থাকতে হবে।

লেখক : ড. এ কে এম খোরশেদ আলম, গবেষক, ভূতত্ত্ববিদ