আমরা কী পারি, আর কী পারি না-এর মধ্যে আটকে আছি কি না এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মনে। হয়তো আমার মতো অনেকের মনেই এ প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। আবার এটা নাও হতে পারে। তবে আমার মনে কেন এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার কিঞ্চিত ব্যাখ্যা পাঠকের কাছে তুলে ধরছি। আমি যেহেতু এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক। তাই নাগরিক অধিকার বলে আমার কথা, নানা বিষয়ে আমার ব্যাখ্যা তুলে ধরতেই পারি। যা-হোক আসল কথায় ফিরে আসি। এই তো গত ২৫ জুন ২০২২ আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে সেতু প্রান্তে উপস্থিত থেকে আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় উদ্বোধন করলেন। পরদিন ভোর থেকে পদ্মা সেতু সবার জন্য উন্মুক্ত হলো। ঘটনাবহুল উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আগে থেকেই আমরা যেন সেতু ফোবিয়ায় ভুগছিলাম। সরকারিভাবে যখন সেতু উদ্বোধনের দিন ঠিক করা হলো, তখন থেকেই উৎসাহ-উদ্দীপনার মাত্রা বেড়ে গেল। কখন আসবে মাহেন্দ্রক্ষণ, সে অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকল বাঙালি জাতি। কিছু লোক ব্যতীত সারা দেশের মানুষই পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক চরম উদ্দীপনায় ডুবে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ, প্রবন্ধ, কলাম প্রকাশিত হতে থাকে। নানা বিশেষণে বিশেষিত হয়, এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অনন্য অভিধায় অভিসিক্ত হন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ জুন যেদিন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয় সব জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। প্রথিতযশা লেখক থেকে শুরু করে অলেখকরাও কলাম লিখেন পদ্মা সেতু নিয়ে। অলেখক বললাম এ জন্য যে, যারা কোনোদিন পত্রিকায় লেখেননি, লেখার অভ্যাসও নেই; কিন্তু ২৫ তারিখের জাতীয় দৈনিকগুলোতে অনভ্যস্ত বেশ কিছু লেখকের লেখা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। আমিও পদ্মা সেতু নিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী কলাম লিখেছি। কিন্তু ২৫ জুন কোনো পত্রিকায় আমি লিখিনি। কেননা, আমার ভয় ছিল অনভ্যস্ত লেখকদের লেখার ভিড়ে আমার লেখা চাপা পড়ে যাবে। সেজন্যই লিখিনি ওই দিন। পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের প্রতীক, সাহসের ও সক্ষমতার প্রতীক। বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে পদ্মা সেতু। এরকম কথা আমরা বলেছি, লিখেছি, এবং এখনও বলছি। এই সেতু নির্মিত হওয়ার ফলে আমরা বীরদর্পে বলে উঠছি আমরা সব পারি। আমরা বীরের জাতি। সবকিছু করার শক্তি সাহস আমাদের আছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণেও বিজয়ী। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেতু নির্মাণ করে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া নিজস্ব অর্থে এ সেতু নির্মাণ সত্যি অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা। তাই আমরা পারি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণের এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। তার ডাকে স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানি জান্তাশাসক আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারেনি। এমন বীরত্বপূর্ণ গৌরবময় ইতিহাস কে না জানে? আবার অন্যদিকে আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করার সাহসও দেখিয়েছে। জেলখানায় চার নেতার হত্যার সাহস, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যার সাহস আমরা দেখিয়েছি। কলঙ্কিত ইতিহাসের জন্মও আমরা দিতে পেরেছি। আমরা সবই পারি। আবার কিছুই পারি না। কেনো পারি না? এই প্রশ্ন করা কী অযৌক্তিক? আমরা জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে পারি না, অহংকার-গৌরব ধরে রাখতে পারি না। জাতির মর্যাদা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে পারি না, তা হলে ধরতেই পারি যে, আমরা সব পারি; কিন্তু কিছুই পারি না। দেখুন সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে প্রকাশ্যে দিবালোকে একজন ছাত্র উপর্যপুরি আঘাত করল, সে আঘাত শিক্ষকের মৃত্যু ঘটল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না। শত শত মানুষের সামনে ঘটনা ঘটলেও শিক্ষককে বাঁচাতে পারলাম না। আবার নড়াইলের আরেক কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পড়িয়ে সড়ক প্রদক্ষিণ করা হলো পুলিশের উপস্থিতিতে। সারা বিশ্বের মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রত্যক্ষ করল। আমরা ওই শিক্ষকের সম্মানমর্যাদা রক্ষা করতে পারলাম না। জুতার মালা শুধু উল্লেখিত শিক্ষকের গলায় উঠেনি, মালা উঠেছে গোটা জাতির গলায়। আমরা আমাদের নিজেদের গলায় জুতার মালা পড়লাম। কয়েক বছর আগে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জাতীয় সংসদের জনৈক সদস্য কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন সে দৃশ্যও বিশ্ববাসী দেখেছে। এমন অবস্থায় পদ্মা সেতুর মর্যাদার ভার বহন করা কতটা সম্ভব হবে, তা জানি না। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাসীকে আমরা কি বার্তা দিলাম?
বার্তা দিলাম যে, আমরা সবই পারি মানমর্যাদা অর্জনও করতে পারি, ধ্বংসও করতে পারি। আমাদের দেশের গৌরবময় ইতিহাসের পাশে কলঙ্কের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ইতিহাসের গতিপথ বড় বন্ধুর। রোমের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তবে কী দেখতে পাই? সেখানে লোকে কখনও কখনও জীবন ও ধর্মকে বীরত্বের অভিব্যক্তি হিসেবে বুঝেছে। তারা অনেক আশ্চর্য কাজ, সৃজনশীল কাজ করেছে, সমৃদ্ধশালী কৃষ্টি ও সভ্যতা গড়ে তুলেছে। এর পরে তাদের মনে এসেছে অবসাদ। শারীরিক দুর্বলতা এসেছে। ফলে ধর্মবোধেও অবক্ষয় ঘটতে শুরু করে। এ অবক্ষয় স্রোত এক সময় সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়। আমরাও কি ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? আমাদের সৃজনশীল প্রেরণা উৎস ধারায় যে ক্ষত দেখা দিয়েছে, তা সারাতে হবে আগে। মানবিক মূল্যবোধ সুপ্ত হয়ে গেছে। ধর্মের নামে ধর্মের অবক্ষয় ঘটে চলেছে। ধর্ম বাঁচানোর নামে নানা রকম ভালোসুলভ আলোচনা চলছে। ধর্মের উদারদিকগুলো আমরা একেবারে ভুলে গেছি। ধর্মীয় দুর্বলতর শ্রেণির মানুষের বিষয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সব ব্যাপারই যেন শুকিয়ে গেছে। এমন হওয়ার কথা ছিল না।
আমরা এক সময় জাতি হিসেবে বড়ই দুর্বল ছিলাম। কারণ স্বাধীনতা বঞ্চিত জাতি স্বভাবতই দুর্বল থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক পদ্ধতির অধীনে যেটুকু সামান্ততান্ত্রিক ক্ষমতা আমাদের ছিল তার প্রয়োগ ছাড়া আমরা কখনও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারিনি। মূল রাজনৈতিক ক্ষমতা আমাদের হাতে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভের পর সে ক্ষমতা আমাদের হাতে এলো। যারা আগে ‘নগণ্য, ব্যক্তি ছিল স্বাধীনতার পর তারাই ‘গণ্যমান্য, ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলো। প্রচণ্ড ক্ষমতা তারা হাতে পেয়ে গেল। একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে স্বাধীনতার এ ৫১ বছরে। কিন্তু এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয় আলোচনা হয়নি যে, ক্ষমতা হাতে পাওয়া যত সহজ; কিন্তু ঠিকমতো প্রয়োগ করা ততো সহজ নয়। কীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে? প্রত্যেকটি স্বাধীন সমাজে এটি একটি বড় বিষয়। পাশ্চাত্যে এ বিষয়টি প্রচুর আলোচিত হয়েছে, এর ওপর অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বার্টান্ড রাসেলের ক্ষমতা বিষয়ে একটি বই আছে। বইটির নাম- Ethics of power (১৩৮ সংস্করণ) এ ১৭০০ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে ‘ক্ষমতাপ্রীতিকে কল্যাণের কাজে নিয়োগ করতে হলে, তাকে অবশ্যই জড়িত থাকতে হবে ক্ষমতার অতিরিক্ত কোনো পরিণামের সঙ্গে।
ক্ষমতার অতিরিক্ত কোনো উদ্দেশ্য থাকাই যথেষ্ট নয়; উদ্দেশ্য এমনই হতে হবে, যে তা সফল হলে, অন্যের বাসনা চরিতার্থে সহায়ক হয়। এটি হলো দ্বিতীয় শর্ত, যা ক্ষমতাপ্রীতিকে পূরণ করতে হবে, যদি তাকে জগৎ কল্যাণমুখী হতে হয়; একে অবশ্যই এমন একটি উদ্দেশ্যের সঙ্গে জড়িত হতে হবে। যেন মোটামুটিভাবে উদ্দেশ্য সাফল্যে যেসব লোক উপকৃত হবে, তাদের বাসনার সঙ্গে সমপর্যায়ভুক্ত হয়।
বার্টান্ড রাসেল কর্তৃক উল্লেখিত ক্ষমতার এ অভিমুখিতাকেই আধ্যাত্মিক উন্নতির ফল হিসেবে ধরা হয়।
রাজনীতিক, পরিচালক, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী, যারই হাতে ক্ষমতা ‘থাকুক, সেখানেই ক্ষমতা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। কারও বেশি ক্ষমতা, কারো কম। সাধারণ নাগরিকের হাতে নির্বাচনের সময় ভোট দেওয়া ছাড়া অতি সামন্যই ক্ষমতা থাকে। কিন্তু সরকারের যে কোনো সামান্য কেরানী, পুলিশ কনস্টেবল বা রাজনীতি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত যে কোনো লোকেরই সাধারণ নাগরিকের চেয়ে ক্ষমতা বেশি থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জাতির, ক্ষমতাবানরা শিখেনি কীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে? আমাদের সংবিধান জনগণের কাছে অনেক বড় বড় বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি ওই সংবিধান অনুযায়ী কর্মানুশীলনের একজন সহায়ক। রাজনীতিক, আমলা, সবাইকে প্রশ্ন করতে হবে এ মর্মে, যে ক্ষমতা আমার হাতে এসেছে তা নিয়ে আমি কীভাবে কাজ করব? যেহেতু ক্ষমতার সঠিক অনুশীলনে আমরা ব্যর্থ তা হলে বড়াই করে কী লাভ?
ক্ষমতাকেই যেখানে সঠিক ব্যবহার করতে পারি না তাহলে আমরা কী পারি? আমরা কিছুই পারি না। বড় বড় উন্নয়ন, বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ তখনই সার্থক হবে, যখন সংবিধানের মহৎ আদর্শগুলোর প্রতি নৈর্ব্যক্তিক আনুগত্য দেখাতে সমর্থ হবো। তখন বলত, পারব আমরা সব পারি- সব পারব। এই মহান বাঙালি জাতি এগিয়ে যাবে সব বাধা পেরিয়ে। যদি ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকে।
ফনিন্দ্র সরকার
কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক