ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ সবার কৌশলগত লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে ওই দেশগুলোর কারো কারো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে; কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা পেছনে ফেলে পদ্মা সেতু তাদের সবার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বক্তব্যেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তাঁরা সবাই পদ্মা সেতুর জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, ভারত উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি করতে চায়। পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগই নয়, ‘বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল (বিবিআইএন)’-এর মতো উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগ বাস্তবায়নেও ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু শুধু ইট ও ইস্পাতের বৃহৎ অবকাঠামোই নয়, এটি বাংলাদেশের দুই অংশের মধ্যে প্রতীকী সংযোগ স্থাপন। এটি শুধু ব্যবসার সংযোগ নয়, দুই প্রান্তের মানুষ, তাদের আবেগ ও সংস্কৃতির সংযোগ। পদ্মা সেতু উদ্বোধন শুধু বাংলাদেশিদের জন্যই নয়, সব বাঙালি, এমনকি ভারতীয় বাঙালিদের জন্যও মহান মুহূর্ত।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ভারত বাংলাদেশের জন্য যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ ঘোষণা করেছিল, পরবর্তী সময়ে সেই ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে ২০ কোটি ডলার ভারত বাংলাদেশকে দিয়েছিল মঞ্জুরি হিসেবে। বাংলাদেশ সেই মঞ্জুরি সহায়তা পদ্মা সেতুতে কাজে লাগানোর ঘোষণা দিয়েছিল।
এদিকে পদ্মা সেতুকে চীনের কৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই)’ অংশ হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছে বিভিন্ন মহল। বিষয়টি নজরে আসার পরপরই ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মাণ করেছে। চীনা প্রতিষ্ঠান এখানে শুধু ঠিকাদারির দায়িত্ব পালন করেছে।
চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বলেছেন, পদ্মা সেতু ‘ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে’ ও ‘এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের’ সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করবে। সেতুটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অবশ্যই ‘আরো সমন্বিত ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া’ এবং এর বাইরেও অবদান রাখবে।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, “পদ্মা সেতু শুধু দুই খণ্ড ভূমিকেই সংযুক্ত করবে না, আমাদের জনগণের হৃদয়কেও সংযুক্ত করবে। এটি ‘অভিন্ন সমৃদ্ধি’ ও ‘অংশীদারির ভবিষ্যতের’ দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ”
উল্লেখ্য, চীনা বিআরআইয়ের লক্ষ্য হলো সমন্বিত ও আঞ্চলিক সংযোগ। বিআরআইতে ‘অভিন্ন সমৃদ্ধি’ ও ‘অংশীদারির ভবিষ্যতের’ কথা বলা হয়েছে।
গত ৫০ বছরে সেতু নির্মাণে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে জাপান। এ পর্যন্ত জাপানের সহযোগিতায় বাংলাদেশে ১৩৪টি সেতু নির্মিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন পরিকল্পনা থেকে সরে যাওয়ার পর জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকাও সেখানে থাকেনি। নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণের পর ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি স্বীকার করেছেন, জাইকার সরে যাওয়া ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
রাষ্ট্রদূত নাওকি বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সামগ্রিক সংযোগ বাড়ানো হবে এবং এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিকে সত্যিকার অর্থে প্রাণবন্ত করবে; গ্রামীণ অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করে তুলবে।
নাওকি বলেন, জাপান তার ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি)’ উদ্যোগের আওতায় শিল্প করিডর নির্মাণের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পে মনোযোগ দিচ্ছে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদারে জনগণ এবং পণ্যকে দক্ষতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে টেকসই পরিবহন অবকাঠামো নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ভেতরে নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সৃষ্টি করবে। এর ফলে বাণিজ্য বাড়বে ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। ’
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলেছে, ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংযোগ উন্নয়নে বাংলাদেশের নেতৃত্বের আরেকটি উদাহরণ। ’
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বা সংযোগের জোরালো সমর্থক।
বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশিরা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশিদের অনেক বড় অর্জন। এই সেতুর জন্য বাংলাদেশিদের গর্ব করা উচিত।
ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটলি পদ্মা সেতু চালু হওয়াকে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের জিডিপিতে বছরে ১.২ শতাংশের বেশি যোগ করবে।
ঢাকায় সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসেফ ঈসা আল দুহাইলান বলেন, পদ্মা সেতু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের চোখ খুলে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে নির্মিত পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
ঢাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্টদূত লি জ্যং-কিউন পদ্মা সেতুকে গর্বের ইতিহাস সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, কোরিয়া এই ইতিহাসের অংশ হতে পেরে গর্বিত। কোরীয় কম্পানি কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন এই সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া তদারকি করেছে। এই কম্পানি সেতু পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে।