অপেক্ষা প্রহর প্রায় শেষ। প্রমত্তা পদ্মার উত্তাল জলরাশি পেরিয়ে ২৫ জুন শনিবার এক উজ্জ্বল সূর্যোদয় বাংলাদেশের জন্য নতুন দিনের আগমনের ঘোষণা দেবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দ্বিতল সেতুর উদ্বোধনের সাথে সাথে বহু বছরের লালিত স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবায়িত হবে।
সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে তিনি টোল পরিশোধ করে সেতু পার হয়ে সকাল ১১টায় মাদারীপুরের শিবচরের ইলিয়াস আলী খান ঘাটে বিশাল জনসভায় যোগ দেবেন।
বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম সেতু উদ্বোধনের মাত্র একদিন বাকি, জাতি অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দিকে।
রোববার সকালে যানবাহন চলাচলের জন্য একেবারে খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। সেতুটি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি মাইলফলক। যা কিনা ২১টি উপকূলীয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষকে রাজধানী ঢাকা এবং এর বাইরে দ্রুত ভ্রমণের পথকে সুগম করবে।
এছাড়াও দ্বিতল বিশিষ্ট্য এই সেতুর মাধ্যমে পন্যবাহী এবং যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচলে দীর্ঘ সময় ধরে ঘাটে বসে থাকার দিন ফুরালো। মেগা প্রকল্পের সমাপ্তি উদযাপনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। এ উপলক্ষে মাদারীপুরের শিবচরের ইলিয়াস আলী খান ঘাটে মহাসমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। সমাবেশে দশ লাখ লোকের উপস্থিতি কামনা করছে ক্ষমতাসীন এই দল।
জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে নির্বিঘ্নে সব ধরনের যান চলাচল নিশ্চিত করতে খুলনা, বরিশাল ও গোপালগঞ্জসহ তিন জেলার মোট ১৫টি সেতু টোলমুক্ত থাকবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সরকার।আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় রয়েছেন নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
বহুল আলোচিত এই প্রকল্পের আওতায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নে সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। সেতুর নিচের অংশ দিয়ে রেল সংযোগ স্থাপন এবং নদী প্রশিক্ষণের কাজ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মোটরসাইকেলের জন্য ১০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও জিপের জন্য ৭৫০ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য টোল হার ঘোষণা করা হয়েছে।
সেতুর ব্যবহারকারীরা ডিজিটাল এবং ম্যানুয়াল উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে টোল দিতে পারবেন। তবে, এই বছর ইলেকট্রনিক টোল আদায় (ইটিসি) শুরু হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চল আর উপেক্ষিত থাকবে না।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় পদ্মার তীরবর্তী এক সময়ের অবহেলিত শিবচর এলাকা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছে। ১৫০ টিরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
সমাবেশস্থলের আশপাশের তিন বর্গকিলোমিটার এলাকা আলোকসজ্জায় আলোকিত করা হয়েছে। পুরো এলাকা নিরাপত্তার দুর্ভেদ্য চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের পাশাপাশি ২০ শয্যার একটি ও ১০ শয্যার দুটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল খোলা হয়েছে।
এছাড়া ৫০০টি অস্থায়ী পাবলিক টয়লেট, ভিআইপিদের জন্য ২২টি অস্থায়ী টয়লেট, সুপেয় পানি, মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, দূর থেকে দেখার জন্য ২৬টি এলইডি মনিটর ও ৫০০ মাইক এবং নৌপথ দিয়ে আসা দর্শক ও অতিথিদের জন্য ২০টি পন্টুনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপন করছে।
অনুষ্ঠানস্থলের দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পেয়ারু সর্দার অ্যান্ড সন্সকে।
মূল সেতু নির্মাণের জন্য চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের অধীনে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি এবং লিংক রোডের জন্য চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেডের সাথে চুক্তি হয়েছিল, যার চুক্তির মূল্য ছিল যথাক্রমে ১২,১৩৩,৩৯ কোটি টাকা এবং ৮,৭০৭.৮১ কোটি টাকা।
সেতুটির জন্য সরকার ২,৬৯৩.২১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে প্রকল্পটি শুরু করে। ১৯৯৯ সালে সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটির প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু হয়। এরপর ৪ জুলাই, ২০০১ এ তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
২০০৭ সালে, তৎকালীন সরকার আনুমানিক ১০, ১৬১ কোটি টাকায় প্রকল্পটি অনুমোদন করে।
২০১০ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র আমন্ত্রণ জানায় যখন বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটির অর্থায়নের জন্য ১.২ বিলিয়ন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু ঋণ প্রদানকারী সংস্থা ঘুষ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী দেশের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
২০১১ সালে, একনেক প্রকল্পটির জন্য ২০,৫০৭.২০ কোটি টাকা সংশোধিত ব্যয় অনুমোদন করে। ২০১৬ সালে, ব্যয় পুনরায় ৮,২৮৬ কোটি টাকা বাড়ানো হলে, মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮,৭৯৩.৩৯ কোটি টাকা।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে, কানাডার একটি আদালত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সকল অভিযুক্তকে খালাস দেয়। সেই সাথে মামলাটিকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করে। কারণ পুরো মামলাটি সাজানো হয়েছিলো কল্পিত তথ্য ও গুজবের উপর ভিত্তি করে।