৫ কারণে পদ্মা সেতু বিশ্ব সেরা

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার
এ পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনও সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমিকম্প, মাটির ক্ষয়সহ যে কোনও আঘাত প্রতিরোধ করে ঠিকে থাকবে পদ্মা সেতু। সব ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে দীর্ঘদিন টিকে থাকার শক্তি রয়েছে পদ্মা সেতুর। আর সেই সক্ষমতা গড়ে তোলার উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর অবকাঠামো। পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটি।

এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে কোনও সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয় নি। ফলে এই ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং পদ্মা সেতুকে অন্য সেতুর তুলনায় অসাধারণ করে তুলেছে।

পাইলের গভীরতা
খরস্রোতা পদ্মার মাটির ১২০-১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর পাইল। এর আগে পৃথিবীর অন্য কোনও সেতুর জন্য এত গভীরে গিয়ে পাইল বসাতে হয়নি। যা একটি রেকর্ড। মূল সেতুতে পাইল রয়েছে ২৬৪টি। নদীর ভেতরে ও দুই প্রান্তে সেতুর ৪০টি পিলারের নিচে পাইপের মতো দেখতে পাইলগুলো বসানো হয়েছে। নদীর পাইলগুলো ভেতরে ফাঁকা, ইস্পাতের তৈরি।

প্রতিটি পাইলের ব্যাসার্ধ তিন মিটার। পুরুত্ব ৬২ মিলিমিটার। একেকটি পিলারের নিচে ছয় থেকে সাতটি পাইল বসানো হয়েছে। এই পাইল নদীর তলদেশের মাটি থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ দশমিক ৪৬ মিটার (প্রায় ৪১২ ফুট) গভীরে বসানো হয়েছে।

সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার
সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। ‘তিয়ান ই’ নামের ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসে ‘তিয়ান ই’। এই ক্রেন দিয়ে ৩ বছর ৯ মাসে ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছিল পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের ওপর।

প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনও সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। এই ক্রেনটির দাম দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

কংক্রিট ও স্টিল উভয়ের ব্যবহার
পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনও সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, নাহয় স্টিলের। পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতি ও বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এখানে যেকোনো সেতু নির্মাণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।

বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন–ব্যবস্থা
পদ্মা সেতুর অন্য রেকর্ডটি হলো নদী-শাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদী-শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদী-শাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচর। ভাঙনসহ নানা কারণে পদ্মা সেতু যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্যই নদী-শাসন করা হচ্ছে। আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দেশি, বিদেশি ও নদীর নিজস্ব (গভীরতা-খরস্রোত) হাজারো প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পারাপারের জন্য উন্মোচিত হবে নবদিগন্তের দুয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তে এখন সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দেশের মানুষ।

এরই মধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পরিবহনের জন্য আলাদা আলাদা টোলের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।