পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় মোংলা বন্দরও

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার, অন্যদিকে মোংলার দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার। এ কারণে আমদানি-রপ্তানিকারকদের দৃষ্টি রয়েছে বাগেরহাটের এই বন্দরে। পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলায় কর্মযজ্ঞ অনেকটাই বাড়বে। আর সে প্রস্তুতিও আছে বন্দরের। চলছে আটটি বড় প্রকল্প।

পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষও। সেতুটি চালুর পর রাজধানী ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর হবে বাগেরহাটের এই বন্দর। ফলে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা এই বন্দরে যোগাযোগ বাড়াবেন।

বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে মোংলা বন্দরের কর্মব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। গতি আসবে আমদানি-রপ্তানিতে।

বন্দরের আশপাশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার প্রত্যাশাও করা হচ্ছে। এতে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান হবে বলে আশাবাদী স্থানীয়রা।

এ বিষয়টি অনুমান করে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

বন্দরে ছয়টি জেটি, তিনটি মুরিং বয়া, ২২টি অ্যাংকোরেজ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ১১টি প্রতিষ্ঠানের জেটির মাধ্যমে মোট ৪২টি জাহাজ একসঙ্গে হ্যান্ডলিং করা সম্ভব।

চারটি ট্রানজিট শেড, দুটি ওয়্যার হাউস, চারটি কনটেইনার ইয়ার্ড, দুটি কার ইয়ার্ডের মাধ্যমে বার্ষিক এক কোটি মেট্রিক টন কার্গো এবং এক লাখ টিইউজ কনটেইনার এবং ২০ হাজারটি গাড়ি হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে বন্দরে।

বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও আটটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে বন্দরের সক্ষমতা অনেক বাড়বে।

পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় মোংলা বন্দরও

 

 

বিজিএমইএর চোখ মোংলায়

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসা জানান, বিজিএমইএ নেতারা তার সঙ্গে এরই মধ্যে বৈঠক করেছেন। কয়েকটি বড় পোশাক কোম্পানিও পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে পণ্য রপ্তানিতে এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

ব্যবসায়ীদের এমন আগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে, ঢাকা থেকে এ বন্দরের দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার এবং পায়রা বন্দর থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৭০ কিলোমিটার। ফলে আমদানি-রপ্তানিকারকরা খরচ কমাতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করবেন।

বন্দরের চেয়ারম্যান জানান, পদ্মা সেতু সামনে রেখে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। সেতু চালু হওয়ার পর বন্দরের যে কর্মতৎপরতা বাড়বে, সেটি সামাল দেয়া যাবে।

বাড়বে গাড়ির ব্যবসা

বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের বন্দরবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আহসান আরজু বলেন, ‘বর্তমানে আমরা আমদানি করা গাড়ি ঢাকায় নিতে আরিচা ফেরিঘাট ব্যবহার করি। যার কারণে মোংলা থেকে একটি গাড়ি ঢাকায় নিতে কমপক্ষে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে।

‘ফলে আমরা যেদিন গাড়ির অর্ডার পাব, সেদিনই ক্রেতার হাতে তা দিতে পারব। যার ফলে সময় বাঁচার পাশাপাশি গাড়িপ্রতি ১-২ হাজার টাকা খরচ কমবে ব্যবসায়ীদের।

‘আবার আমাদের সংগঠনের প্রায় ৩০০ সদস্য মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি করেন। কম সময়ে গাড়ি খালাস ও রাখার পর্যাপ্ত জায়গা থাকায় ব্যবসায়ীরা এই বন্দর দিয়ে আমদানি করতে বেশি পছন্দ করছেন। পদ্মা সেতু চালু হলে বন্দর দিয়ে আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আরও বাড়বে।’

২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি শুরু হয়। ওই বছর গাড়ি এসেছিল ২৫৫টি। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) মে মাস পর্যন্ত এ বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়েছে ২০ হাজার ৯টি।

মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ নেয়াজুর রহমান বলেন, ‘মোংলা বন্দর দিয়ে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায়, তার ৫২ শতাংশ আসে গাড়ি আমদানির কর থেকে।’

পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় মোংলা বন্দরও

রাজস্ব বাড়ার আশা

১৯৯০-৯১ থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত বন্দরটি লাভজনক ছিল। তবে ২০০২-০৩ থেকে ২০০৬-০৭ অর্থবছর পর্যন্ত লোকসানের শিকার হয় বন্দরটি। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে আবারও লাভের মুখ দেখে তারা।

সর্বশেষ চার বছর ধরে এ বন্দর থেকে ১০ হাজার লাখ টাকার বেশি লাভ হচ্ছে।

মোংলা বন্দরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে বন্দরে জাহাজ এসেছে ৮২৮টি ও গেছে ৮৩০টি। এতে বন্দরের মোট আয় হয়েছে ৮ হাজার ৩০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে আগামী অর্থবছরে আমরা রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারব বলে আশাবাদী।’

মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার নেয়াজুর রহমান বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমাদের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। ১১ মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে দ্বিগুণের মতো। আয়ের প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে কম খরচ ও কম সময় ব্যয় করে ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য নিতে পারবেন। তখন বন্দরে বেশি আমদানি-রপ্তানি হবে, রাজস্বও বাড়বে।’

বিনিয়োগ বাড়ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য মতে, বিভাগে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে ১০৩টি প্রতিষ্ঠান। এতে ২ হাজার ৩৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ করেছে ৩১টি ব্যবসায়ীপ্রতিষ্ঠান। এতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৪৫ কোটি ২৭ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

বাগেরহাট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে বাগেরহাট জেলার উন্নয়নের জন্য বাইরে থেকে টাকার প্রয়োজন হবে না। কারণ পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী হবে।’

‘বর্তমানে মোংলা বন্দর এলাকায় ছোট-বড় মিলে ৩৮৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু পদ্মা সেতুর কারণে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখানে জমি কিনেছে। তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ চলমান রয়েছে। যার ফলে এ অঞ্চলে শিল্পবিপ্লব শুরু হবে। বেকারত্ব দূর হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে কয়েক লাখ মানুষের।’

পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় মোংলা বন্দরও

কোন কোন প্রকল্পের কাজ চলছে

৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘স্ট্র্যাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর মোংলা’;

সমুদ্রগামী জাহাজ, বন্দর অফিস ও আবাসিক এলাকাসহ বন্দরসংলগ্ন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ২৪ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে চলেছে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন;

বন্দরের কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪৩৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ;

নিরাপদ চ্যানেল বিনির্মাণ, সমুদ্রগামী জাহাজ সুষ্ঠুভাবে হ্যান্ডলিং এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় জরুরি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৭৬৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সহায়ক জলযান সংগ্রহ;

বন্দর এলাকায় চলাচলকারী জলযান এবং শিল্প-কারখানা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য ৪০১ কোটি ২৪ লাখ টাকায় চলছে ‘মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা’;

ইকুইপমেন্টসহ কনটেইনার টার্মিনাল, হ্যান্ডলিং ইয়ার্ড, ডেলিভারি ইয়ার্ড, সার্ভিস ভেসেল, মেরিন ওয়ার্কশপ কমপ্লেক্স, মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ কমপ্লেক্স, ওভারপাস, বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা ও বন্দর ভবন সম্প্রসারণ এবং আটটি জলযান সংগ্রহের ‘আপগ্রেডেশন অফ মোংলা পোর্ট’, যার ব্যয় ৬ হাজার ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা;

মোংলা বন্দরের জেটি পর্যন্ত ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সুবিধা সৃষ্টির জন্য ‘ইনার বার’ এলাকায় ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ টাকায় ২১৬ দশমিক শূন্য ৯ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের জন্য ‘পশুর চ্যানলের ইনার বারে ড্রেজিং’ প্রকল্প; এবং

মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইকুইপমেন্টসহ দুটি অসম্পূর্ণ জেটি নির্মাণের লক্ষ্যে পিপিপির আওতায় ৪১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা বন্দরের দুটি অসম্পূর্ণ জেটি নির্মাণ।

পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় মোংলা বন্দরও

 

 

অনুমোদনের অপেক্ষায় ছয় লেন প্রকল্প

পদ্মা সেতু ঘিরে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল খুলনা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করা।

বাগেরহাট সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘১৯৮৪ সালে সড়কটি নির্মাণ হওয়ার পর থেকে প্রশস্ত করা হয়নি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ সড়কে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। সে কারণে সড়কটির বাগেরহাট অংশের সাড়ে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা ছয় লেনে উন্নীতকরণ এখন সময়ের দাবি।

‘ইতোমধ্যেই প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি ডোনারের মাধ্যমে করা যায় কি না সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা করছে। কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকও হয়েছে বিষয়টি নিয়ে।’