রাজধানী থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাতায়াতে পদ্মা পাড়ি দিতে সবাইকে দুই ঘণ্টার মত বাড়তি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। আর ফেরিতে পারাপারে অনেক সময় লেগে যায় তিন ঘণ্টাও। তবে পদ্মা সেতুর কাজ শেষে উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় এখন অনেকটাই স্বস্তিতে আছেন নিয়মিত পদ্মা পাড়ি দেয়া লোকজন।
তাদেরই একজন বরিশালের গৌরনদীর সাবিদ রেহমান বলেন, ‘ঈদের সময় ফেরিতে ওঠার জন্য যানবাহনগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঈদুল আজহায় এবার সেতু দিয়ে স্বস্তিতেই বাড়ি যেতে পারবো।’
৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণ করা ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হবে। এর ফলে নদী পারাপারে অর্থ ও সময়ের সাশ্রয় হবে, কমে আসবে জীবনের ঝুঁকিও।
সরকারের দলিল বলছে, পদ্মা সেতু চালু হলে হালকা যানবাহন বাস ও ট্রাক মিলে ২,৬২০ পরিবহনের প্রতি দিন ফেরির অপেক্ষার মোট ১৮৭,৭২৭ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে। এর ফলে বছরে সাশ্রয় হবে ৬৮০ কোটি টাকা।
পরিবহন সময় কমে আসায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে শিল্প, আবাসন, বাণিজ্য ও পর্যটনের সুবিধা ব্যাপক হারে বাড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার পরিচালনা করা একটি সমীক্ষা বলছে, পদ্মা সেতু চালু হলে যাতায়াত ও পরিবহন সুবিধা বাড়বে বলে জাজিরা প্রান্তের শতভাগ মানুষের বিশ্বাস। আর চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করেন ২০ শতাংশ মানুষ।
ব্যবসার সুবিধা বাড়বে বলে মনে করেন মাওয়া প্রান্তের ৭৫ শতাংশ মানুষ। জাজিরা প্রান্তে এমন মতামত দিয়েছেন ২০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। আয় বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার মান বাড়বে বলে মনে করেন দুই প্রান্তের অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ।
পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে ব্যবসা বৃদ্ধির বিষয়ে মাওয়া প্রান্তের ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করলেও জাজিরা প্রান্তের ৪০% মানুষ এটা মনে করেন। শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান হবে বলে মনে করেন অর্ধেক মানুষ।
সেতুর কারণে জমির দাম বাড়ছে বলে মনে করেন মাওয়া প্রান্তের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ। জাজিরা প্রান্তে জমির দাম বাড়বে বলে আশাবাদী প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ। সেতুর কারণে নদীভাঙ্গন কমবে বলে মাওয়া প্রান্তের শতভাগ মানুষ মত দিয়েছেন। যদিও জাজিরা প্রান্তের মাত্র ৬০ শতাংশ মানুষ এটা বিশ্বাস করেন।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সেতু নির্মাণের ফলে পরিবহনে সময় ও অর্থ কম লাগায় দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলে শিল্পায়নে গতি আসবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকেই এ প্রবণতা শুরু হয়েছে। আগামীতে তা আরও বাড়বে।
সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে জাইকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পানির স্তর উচ্চ থাকলে মাওয়া থেকে জাঞ্জিরা পর্যন্ত গড় পারাপারে আড়াই ঘণ্টা এবং অন্য সময় দুই ঘণ্টা লাগে।
প্রায় ৬২,৫০০ যাত্রী প্রতিদিন ঢাকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি নদী পার হয়। যানবাহনের সংখ্যার দিক থেকে বলা যায়, প্রতিদিন ২,৯০৯টি যানবাহন পদ্মা পাড়ি দেয়, যার মধ্যে ১,২৯৫টি ট্রাক, ৭০০টি হালকা যান এবং ৯১৪টি বাস।
ট্রাকগুলো ফেরিতে নদী পার হওয়ার কারণে কোনো পণ্য লোড-আনলোড হয় না। তবু ট্রাকগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। এতে শুধু কয়েক ঘণ্টাই না, কখনো কখনো কয়েক দিনও লেগে যায়।
একটি বাস বা কোচকে ফেরির জন্য ৬৬ মিনিট অপেক্ষা করে থাকতে হয় যেখানে একটি ট্রাকের জন্য অপেক্ষার সময় ১০৯ মিনিট। অপেক্ষার সময় ধরলে নদী পার হতে একটি বাসের সবমিলিয়ে লেগে যায় ১৮৮ মিনিট। অন্যদিকে ট্রাকের লাগে ২৩১ মিনিট।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে গতি বৃদ্ধির কারণে গাড়ির দৈনিক পরিচালন ব্যয় কমে আসবে। এর ফলে সব পরিবহনের বছরে মোট সাশ্রয় হবে ৪৩৮ কোটি টাকা। আর ফেরির অপেক্ষার সময় যোগ করলে মোট সাশ্রয় হওয়া সময়ের মূল্য দাঁড়ায় ১,১১৮ কোটি টাকা।