টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বীজ উৎপাদনে যেতে হবে

বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা টেকসই করতে নিজস্ব বীজ উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ বীজের আমদানিনির্ভরতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বীজ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জনে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ প্রয়োজন।

দেশের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের কৃষি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্প সম্পর্কিত কমিটির একাধিক সদস্য কালের কণ্ঠকে এ কথা বলেছেন।

দেশে যে পরিমাণ বীজের প্রয়োজন, তার ৯৩ শতাংশ আমদানি করা হয়। বাকি ৭ শতাংশ উৎপন্ন হয় স্থানীয় পর্যায়ে। এই পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে চাহিদামতো বীজ উৎপাদনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদরা।

কৃষিবিদরা বলছেন, বীজ উৎপাদনে শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে বিদ্যমান বীজ আইনও সংশোধন করতে হবে। বর্তমানে দেশে প্যারেন্ট লাইন বীজের প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। বীজের প্যারেন্ট লাইন উৎপাদনে যেতে গবেষণা কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি যেসব দেশ বীজ উৎপাদন করে, তাদের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে চুক্তিতে যেতে হবে। এভাবে যৌথ মেধাস্বত্বের ভিত্তিতে দেশে বীজ উৎপাদন সম্ভব।

জানা গেছে, বীজ ও প্যারেন্ট লাইন বীজ আমদানিতে প্রতিবছর গড়ে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে বীজের পেটেন্টের জন্য। দেশে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হলে আমদানি ব্যয় ১৫০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব।

বীজ সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি নিয়ে কৃষিবিদ জাহাঙ্গীর খান বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে বীজ সংরক্ষণ করতেন, সেটিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রূপান্তর করে দেশেই শতভাগ বীজ উৎপাদন সম্ভব। বীজ আমদানিতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। আবার বীজ উৎপাদন সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালা খুব জটিল। এটি আরো সহজ করে সবার জন্য বীজ উৎপাদন উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। ’

জাহাঙ্গীর খান কীটনাশক প্রসঙ্গে বলেন, কীটনাশক তৈরিতে বাহক হিসেবে ব্যবহৃত উপাদানের ৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাকি ৯৫ শতাংশ উপাদান স্থানীয়। কিন্তু এই ৯৫ শতাংশ উপাদানকেও আমদানির প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। এটা রোধ করতে হবে।

টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা

বিশ্বের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে লন্ডনভিত্তিক দি ইকোনমিস্টের ‘ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্ট’। ২০২১ সালে দেখা গেছে, বৈশ্বিক টেকসই খাদ্য সূচকে ৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম।

সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা ২০টি দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ। টেকসই খাদ্য সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর এক শর মধ্যে ৬১।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই কৃষি অর্থনীতি বাস্তবায়নে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উপকরণ, যেমন—বীজ, সার, কীটনাশক, সেচযন্ত্র ও প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতি—এগুলো কৃষকের আয়ত্তের মধ্যে আছে কি না, গুণগত মান কেমন—এ বিষয়গুলোও নিশ্চিত করতে হবে। সেচযন্ত্র, পণ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতির বেশির ভাগ এখন আমদানি করতে হয়। এগুলোর কোনো কোনোটির দাম প্রান্তিক কৃষকের নাগালের বাইরে। প্রশ্ন রয়েছে মান নিয়েও।

বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কৃষিবিদ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকসই কৃষি অর্থনীতি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। স্থানীয় ভোক্তার চাহিদা নিরূপণ, কলকারখানার কাঁচামাল এবং আন্তর্জাতিক বাজার, উৎপন্ন পণ্য—এই তিনভাবে দেখতে হবে বিষয়টিকে। এই তিন জায়গায় সমন্বয় করা গেলে টেকসই কৃষি অর্থনীতি নিশ্চিত করা যাবে। ’ মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, কৃষি উৎপাদন বাড়লেও প্রকৃত কৃষক মূল্য পান না। এটি কৃষি খাতের বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে দরকার টেকসই কৃষি অর্থনীতি। সরকারি প্রণোদনা ও কৃষিঋণ সঠিক লোক পাচ্ছে কি না, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। কারণ সরকারের প্রণোদনা ছাড়া কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করার পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণ ও গবেষণায় জোর দিতে হবে।

প্রতিবছর কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হলেও সেই অর্থ যথাযথ জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ভর্তুকির টাকায় কৃষি অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রতি জোর দিতে হবে। এমনকি ব্যাংক থেকে নেওয়া কৃষিঋণও সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে মনে করেন তাঁরা।