চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও তারুণ্যের প্রস্তুতি

প্রতিটি শিল্পবিপ্লব মানবজাতির ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা, চিন্তনক্ষমতা, কারিগরি দক্ষতা এবং সমাজ ও সংস্কৃতিকে পালটে দিয়েছে। পরিবর্তন করেছে সমগ্র বিশ্বের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি। ১৭৮৪ সালে ইংল্যান্ডে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার ও সর্বশেষ তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে সমগ্র বিশ্বের গতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পৃথিবী এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মুখে আমাদের স্বদেশ বাংলাদেশও। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উত্পাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় টিকে থাকতে হলে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। আর দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রধান উত্স শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর হিসাব অনুযায়ী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত মিলিয়ে প্রতি বছর ২৫ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু দক্ষতার অভাবে কাজ মিলছে না সবার। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় মিল না থাকায় চাকরি প্রত্যাশীরা ভুগছে হতাশায়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও গতানুগতিক সিলেবাস চলে বলে শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যত্ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। এরই মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কড়া নাড়ছে দরজায়। এই বিপ্লবে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তিবিষয়ক বাস্তব জ্ঞান একান্ত প্রয়োজন। আর কম্পিউটার ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাও আবশ্যক। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, বিআইজিডি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। সেখানে দেখা যায়, ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কম্পিউটার দক্ষতা ও ইংরেজি ভাষায় আত্মবিশ্বাসীর সংখ্যা মাত্র ১৬ শতাংশ। যদিও দিন দিন এসবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু সেটা তুলনামূলক নিছক কম। শহর অঞ্চলের তরুণ-তরুণীদের কম্পিউটার প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষতা গ্রামাঞ্চলের তরুণ-তরুণীদের চেয়ে তুলনামূলক অনেক এগিয়ে। তাছাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকলেও আর্থিক অসচ্ছলতা ও কম্পিউটার দক্ষতার বাস্তবিক প্রয়োগ ও সুশৃঙ্খল ব্যবহার না থাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের অনীহা। যদিও সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে টিকে থাকার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তন্মধ্যে একটি সফল উদ্যোগ ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণ। বিগত কয়েক বছর যাবত্ এই প্রজেক্টের আওতার অনেক শিক্ষার্থীকে বিদেশি মার্কেট প্লেসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এবং তারা সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে এই বিপ্লবের সুফল যথাযথভাবে ভোগ করবে বাংলাদেশ।

আর তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় আমাদেরকে নবীন উদ্ভাবনী কৌশল আর দক্ষতা বৃদ্ধিতে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। এজন্য কারিগরি শিক্ষা হতে পারে এর প্রধান হাতিয়ার। বাংলাদেশে অধ্যয়নরত তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভোকেশনাল অর্থাত্ কারিগরি শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার মান খুবই নিম্ন পর্যায়ে। এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক কম থাকায় ব্যবহারিক ক্লাসগুলোও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয় না। তাছাড়াও পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চার বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করা ছেলেমেয়েদেরও চাকরি মিলছে না। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে ব্যবহারিক ঘাটতি থাকায় তৈরি হচ্ছে এমন বৃহত্ প্রতিবন্ধকতা। যদিও সরকার কারগরি শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য ব্যাপক জোরদার প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে। তবু নানা রকম প্রতিকূলতার কারণে সর্বত্র এই শিক্ষার ছোঁয়া এখনো সীমাবদ্ধ।

তাই ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হতে হবে সুদক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি। আর এজন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন। পাশাপাশি ঝরে পড়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে হবে কারগরি শিক্ষার আওতায়। এজন্য প্রয়োজন সম্প্রসারিত গবেষণা, বাস্তবমুখী উদ্যোগ এবং সেই উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন।

জাহিদুল হাসান সোহান

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়