ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি- এটা কম কীসের

রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার ৬ নম্বর মাটিকাটা ইউনিয়নের কাদিপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে পা রাখতেই দৃষ্টি পড়ল একটি ঘরে। তখন ভরদুপুর। ঘরের সামনে নির্মাণ হচ্ছে মঞ্চ। টানানো হচ্ছে শামিয়ানা, বৈদ্যুতিক মরিচাবাতি। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। জানা গেল, বৃহস্পতিবার রাতে একটি বিয়ের আয়োজন আছে। সমীর রবিদাস ও সিন্ধু রবিদাসের মেয়ে নূপুর রবিদাসের বিয়ে। প্রস্তুতি সম্পন্ন।

অথচ বছর দুয়েক আগেও তাদের জীবনের গল্পটা ছিল অন্য রকম। নদীভাঙনে জমিজমা বিলীন হয়ে গেলে চার মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে অজানা শঙ্কায় দিন কাটাতে থাকেন সমীর ও সিন্ধু রবিদাস। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে জায়গাসহ একটি ঘর পেয়েছেন তারা। এরপরই বদলে যায় তাদের জীবন-বাস্তবতা। অবসান ঘটে বিদিরপুরের কষ্টের সেই জীবন। নতুন স্বপ্নে পথচলা শুরু হয় তাদের। ঘর পেয়ে নিজস্ব আবাস নিশ্চিত হয় তাদের। সেখানে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের দায়িত্ব নেন বাড়ির নারীরা। ভ্যান চালিয়ে আয়-রোজগার করেন পুরুষরা। এতে করে মাস শেষে তাদের কিছু উদ্বৃত্তও থাকে।

বিদিরপুরের জীবন থেকে বর্তমান জীবনের বিষয়ে জানতে চাইলে সিন্ধু রবিদাস বলেন, অনেক কিছুই হয়েছে। না হলে এতগুলো মানুষ চলছি কী করে! আগের মেয়ের বিয়েতে এমন আয়োজন ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তখন কি আর আমাদের জীবন ছিল গো!’
গোদাগাড়ী উপজেলার এই কাদিপুর গ্রামে মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় সেখানে মোট ৩৭টি জায়গাসহ ঘর নির্মিত হয়েছে। তিনটি ঘরে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার, যাদের আদি পেশা জুতা সেলাই করা। বাকি ৩৪টি ঘরে আছে মুসলিম পরিবার। তাদের সবাই বিদিরপুরের বাসিন্দা ছিলেন। সবাই নদীভাঙনের শিকার।

গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের রানীনগর গড়বাড়ি গ্রামে আরেক আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে রয়েছে ৬৫টি ঘর- দ্বিতীয় ধাপের ৬০টি ও তৃতীয় ধাপের পাঁচটি। গড়বাড়ি আশ্রয়ণ এলাকায় প্রবেশপথে বাঁ পাশে জুলেখা বেগমের ঘর। ঘরের বারান্দায় নিয়ে বসেছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, অর্থাৎ ছোট্ট মুদি দোকান। ৬৫টি বাড়ির প্রায় সবাই তার কাছ থেকে কেনাকাটা করে। পঞ্চাশোর্ধ্ব জুলেখা বেগমের ছেলে আবদুল হাদীও তার পাশের বাড়িটি পেয়েছেন। এলপি গ্যাসের চুলায় তিনি চা বানিয়ে তার ঘরের বারান্দায় বিক্রি করেন। আর দিনের একটা সময়ে চালান অটোরিকশা। বাসায় টিভি, ফ্যান ও ডিশলাইন, এলপি গ্যাস ব্যবহারে তাদের জীবনে স্পর্শ করেছে শহুরে আবহ।

জুলেখা বেগমের ভাষ্য, ‘শেখ হাসিনা ভালো বাইস্যা দিয়েছেন, তাই লবণ-তেলের পয়সা (জীবন চালানোর ব্যবস্থা) হয়েছে।’ কথায় যোগ দেন তার স্বামী আশবাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পাশের অঞ্চল আলীপুরের জায়গা নদীতে বিলীন হওয়ায় আমরা এখানে এসে আশ্রয় নিই। পরে সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় পাকা ঘরে ওঠার সুযোগ হয়। নিজের আধাপাকা বাড়ি হয়েছে। বিদ্যুতের আলো ও বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি- এটা কম কীসের!

এখানে বেশিরভাগ ঘরের বারান্দায় গরু-ছাগল বেঁধে রাখতে দেখা গেছে। এগুলো লালন-পালনের পাশাপাশি তারা অটোভ্যান চালানো, দিনমজুরের কাজ করাসহ যখন যে কাজ পান, তা-ই করে জীবনে সচ্ছলতা আনছেন। ৪০ বছর বয়সী শরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়ায় প্রতিবছর ঘর সংস্কারের খরচ বেঁচে গেছে। সেসঙ্গে বেড়েছে বাড়ির নিরাপত্তা। তিনি চারটি গরু পালনের পাশাপাশি কৃষিকাজ করেন। তার স্ত্রী হানুকা খাতুন করেন সেলাইয়ের কাজ। ফলে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তাদের কিছু আয় থাকে।

এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে উপহারের ঘর পাওয়া রানীগড়ের তৈয়ব আলীর মুখে চওড়া হাসি দেখা গেছে। একবার তার সব শেষ হয়েছিল নদীভাঙনে। পরে বাবা-ছেলে মিলে কিছু আয় করে মালদ্বীপ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মালদ্বীপ গিয়েছিলেনও। কিন্তু তাকে ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানো হয় বলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। অন্তহীন হতাশা নিয়ে শুরু হয় আরেক জটিল জীবন। পরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি পেয়ে বদলে গেছে তৈয়ব আলীর জীবন।

তিনি সেখানে তার বরাদ্দ পাওয়া জায়গায় এবং বাইরে আরেকটু জায়গা নিয়ে তিনটি মহিষ, একটি গরু ও দুটি ভেড়া পালন করেন। খড়কাটার মেশিনও আছে তার। সরকারি বরাদ্দকৃত সুপেয় পানির বাইরে তিনি আরেকটি সাবমারসিবল বসিয়েছেন। সেই পানি দিয়ে গরু-মহিষ ধোয়ার কাজ করেন। এভাবে একেকজন একেক কাজের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন বদলে দিয়েছেন।