বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিবেশী দেশেগুলোর তুলনায় যথেষ্ট অগ্রগামী

স্বাধীনতার ৫১ বছরে সারা বিশ্বের দরবারে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের এক রোল মডেল। অথচ স্বাধীনতার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। সেখান থেকে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এক সময়কার শুধুমাত্র পাট ফলানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত, তলাবিহীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ নামের এই দেশটি আজ বিশ্বের দরবারে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে আছে।

স্বাধীনতার ৫১ বছর দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে ৫২ গুণের বেশি আর ৯৩ ডলার থেকে মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ২৬শ ডলার উন্নত হয়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হার, বেড়েছে কর্মসংস্থান, রপ্তানি বাণিজ্য। প্রভূত উন্নতি হয়েছে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে। রফতানি ও প্রবাসী আয়ও চোখে পড়ার মতো। হয়তো যতটুকু আশা করেছিলাম সকলে ততটুকু হয়নি, কিন্তু যা হয়েছে তাও নেহায়েত কম নয়। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে ৭১ এ যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশ। বিস্ময়করভাবে উত্থান হয়েছে দেশের অর্থনীতির। আর্থিক সূচকের পাশাপাশি সাফল্য আছে প্রতিটি সামাজিক সূচকেও।

তবে যে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, তা আজও অর্জিত হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশের মধ্যেই বিরাজ করছে দুই ধরনের অর্থনীতি। সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত না হলে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামগ্রিতভাবে পরিমাণগত সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে।

এর সুফল সবার কাছে পৌঁছানো জরুরি। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ৫১ বছরের আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ভালোই আছে দেশের অর্থনীতি। সেখানে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বেশ ভালো অবস্থান। তবে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। কারণ অর্জনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রপ্তানি।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের রপ্তানি খাত গার্মেন্টনির্ভর। কোনো কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যটি মার খেলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় আসবে। এ খাতে রপ্তানিতে পণ্যের বহুমুখীকরণে জোর দিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, রপ্তানি আমদানি বেড়েছে। আমদানি বিনিয়োগ সত্যি ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে। অর্থনীতির আকারে বর্তমান বিশ্বে ৪০তম বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বিশ্বব্যাংক থেকে স্বীকৃতি মিলেছে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার। এসব অর্জন বাংলাদেশের সক্ষমতার পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়িয়েছে।

বর্তমানে ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, ক্রিকেটে, আউটসোর্সিং ও বাইসাইকেল রপ্তানিতে অষ্টম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফল উৎপাদনে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ।

এ অর্জন শহিদদের জানান দেয়, তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ৫১ বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ সেই স্বপ্ন পূরণের নাম বাংলাদেশ।
তবে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্জনের তালিকা দীর্ঘ। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি বেশি। এর অন্যতম হলো দারিদ্র্য বিমোচন।
কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। তবে এ দুই খাতে সামগ্রিক গুণগত মান আরও উন্নতি করা জরুরি।

এছাড়া মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় বড় ভৌত অবকাঠামো অর্জনের পাল্লাকে অনেক ভারী করেছে। আরও আছে নিজস্ব স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন চলমান মেগা প্রকল্প।
আর সবকিছুকে ছাপিয়ে ক্রিকেটের অবিশ্বাস্য উন্নতি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুনরূপে পরিচিতি দিয়েছে। এসেছে বিশ্ব শান্তিতে নোবেলও। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই দেশটি এখন বিশ্বে উন্নয়নের ‘রোড মডেল’।
তবে সামনের দিনগুলোতে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সম্পদ, আয় এবং ভোগের ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য রয়েছে। মোট সম্পদের প্রায় ৫২ শতাংশই উচ্চ শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের হাতে। আর নি¤œ শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র দশমিক ০৪ শতাংশ।

এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, প্রাথমিক শিক্ষা এবং নারীশিক্ষাসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বিশাল অর্জন হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণে সুপারিশ মিলেছে।

বর্তমানে তা প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৩ ডলার। বর্তমানে তা ২৫৯১ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
আমদানি মাত্র ২৮ কোটি ডলার থেকে এ বছর শেষে ৮৮ বিলিয়ন, রপ্তানি ৩৩ কোটি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) আসত ৮০ লাখ ডলার।
৫ দশকে তা ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৪৭ থেকে প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে।

১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৮৮ শতাংশ, সেখানে আজ এ হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৪৭ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমেছে। জাতিগঠনের অন্যতম উপাদান শিক্ষা।
৫০ বছরে সেখানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৭২ সালে শিক্ষার হার ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে তা ৭২ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ১৬০ থেকে কমে ৩ দশমিক ৮ এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৬ থেকে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৭২ সালে ১০ হাজার ৪৯০ জন মানুষের জন্য একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছিল। বর্তমানে দুই হাজার ৫৮০ জনের জন্য একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ওই সময় ৪০ শতাংশ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। কিন্তু কিছুটা খাদ্য আমদানি করা হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার খাদ্য রপ্তানিও করা হচ্ছে। ওই সময়ে দেশে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮ লাখ টন। বর্তমানে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া শিল্প খাতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ৫১ বছরে কৃষিকে ছাড়িয়ে গেছে শিল্প।

হালকা প্রকৌশল, সফটওয়্যার ও ওষুধ শিল্প অনেক এগিয়েছে। বর্তমানে গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। চীনের পরই আমাদের অবস্থান। এ গার্মেন্টই বিশ্বে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে পরিচিতি দিয়েছে।