দেশের সীমানা পেরিয়ে বর্হিবিশ্বের বাজারেও এখন পঞ্চগড়ের চা। সবুজ চায়ের সমাহার নামে খ্যাত উত্তরের প্রবেশদার জেলা পঞ্চগড়। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পর চায়ের জেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই জেলা। গত দুই দশকে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমির চা-শিল্পে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেসব উঁচু জমিতে কোনো ফসল হতো না, পতিত অবস্থায় পড়ে থাকত, সেসব জমিতে চা চাষ করে এ জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে চা-চাষি ও শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের।
তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে পঞ্চগড় সফরে এসে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেন। অতঃপর ওই সময়ের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেনের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ করা হয়। প্রথমে টবে, পরে জমিতে চায়ের চাষ করা হয়। সে সফলতা থেকে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদন করা হয়।
চা চায়ের চাষাবাদ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে পঞ্চগড়। পাশাপাশি পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নীলফামারীও ব্যাপক অগ্রসর হচ্ছে চা শিল্পে। তবে পঞ্চগড়ে প্রায় ৪০ হাজার একর জমি চা চাষের উপযুক্ত বলে বলছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।
চা চাষ করে স্থানীয় কৃষকরা যেমন ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন, তেমনি এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত চা-শ্রমিকদের জীবনও বদলে গেছে। চায়ের ওপর নির্ভর করছে তাদের জীবন-জীবিকা। পঞ্চগড়ের পাঁচটি উপজেলায় কমবেশি চা-বাগান গড়ে উঠেছে। এছাড়া জেলাজুড়ে গড়ে উঠেছে ছোট বড় হাজারো চা-বাগান। সমতলের চা চাষ বদলে দিয়েছে হাজার কৃষক শ্রমিক ও বেকারের ভাগ্য।
চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে চা-বাগান, প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ও প্যাকেটজাতকরণ ছোট কারখানাগুলোতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রায় অর্ধেকই নারী। চা-বাগান ও কারখানাগুলোতে কাজ করে এখন অনেকেরই জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে। এদিকে চা-শিল্প থেকে প্রতিবছর সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব আদায় হচ্ছে।
চা বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে পঞ্চগড় জেলায় ১৬ হাজার একর জমি, চা চাষের উপযোগী রয়েছে। তার মধ্যে জেলায় ৮ হাজার ৬৪২ একর জমিতে চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে। চা চাষ সম্প্রসারণ হওয়ায় বর্তমান জেলায় ১৭টি চা কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব চা কারখানা গত বছরে তৈরি চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ কোটি কেজি। কিন্তু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে প্রায় তিন লাখ কেজি। জেলায় বর্তমানে ৯টি নিবন্ধিত চা বাগান (টি এস্টেট), ১৬টি অনিবন্ধিত চা বাগান, ৯৯৮টি নিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান এবং ৫ হাজার ৫০০ অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান রয়েছে।
নর্দান বাংলাদেশ, চা বোর্ড, পঞ্চগড়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন জানান, পঞ্চগড়ের চা বিভিন্ন জেলাসহ বিদেশেও রফতানি হয়ে থাকে। সমতলে চা চাষ করে মানুষ তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। চা-চাষিদের আমরা সব ধরনের সেবা ও পরামর্শ দিয়ে। ইতোমধ্যে পঞ্চগড়ে যেন একটি অকশন বাজার স্থাপন করা হয়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পর তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়।
চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে চা চাষের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যন্ত ৩৩টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় ১৭টি ও ঠাকুরগাঁও জেলায় ১টি কারখানা চালু রয়েছে। এই কারখানাগুলো চাষিদের কাছ থেকে সবুজ পাতা কিনে তা থেকে চা তৈরি করে। এই চা নিলাম বাজারে বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা। গত মৌসুমে একেকটি কারখানা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ কেজি পর্যন্ত তৈরি চা উৎপাদন করেছে।
২০১৮ সালে উত্তরাঞ্চলে সবুজ চা পাতা উৎপাদন করা হয়েছে ৪ কোটি ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮১ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি। ২০২০ সালে সবুজ চা–পাতা (কাঁচা) উৎপাদিত হয়েছে ৫ কোটি ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৬ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি। গত মৌসুমে তৈরি চায়ের জাতীয় উৎপাদন হয়েছে ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজি। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ৫টি জেলা—পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতেই উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি, অর্থাৎ ১০ দশমিক ৩০ মিলিয়ন কেজি; যা গত মৌসুমের চেয়ে ৭ দশমিক ১১ লাখ কেজি বেশি। এবার জাতীয় উৎপাদনের ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ চা যুক্ত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি থেকে।
উত্তরাঞ্চলের চা– বাগান ও কারখানাগুলোতে কাজ পেয়ে এখন অনেকেরই জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে। চা–শিল্প থেকে প্রতিবছর সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব আদায় হচ্ছে। ২০১৯ সালে উত্তরাঞ্চলে ৯৬ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছিল। ওই সময় তৈরি চায়ের দাম বেশি থাকায় উৎপাদিত তৈরি চা বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকায়, যা থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩০ কেটি টাকা। এরপর ২০২০ সালে এক কোটি তিন লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছিল, যা বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৫৬ কোটি টাকায়, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এ এলাকার চা চাষের বিশেষত্ব হচ্ছে কৃষকরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা বাগান গড়ে তুলছে। যা প্রান্তিক চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জেলায় চা চাষ হওয়ায় চাষিদের ৯ মাসের আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। হয়েছে স্থানীয় বেকার যুবদের কর্মসংস্থান। জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। বাগানগুলোকে কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া চা বাগান দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে পর্যটক। এতে জেলার চিত্র গত কয়েক বছর আগের তুলনায় পাল্টে গেছে কয়েক গুণ। বেড়েছে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ। সেই সাথে সরকারি কোষাগারে যোগ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।