আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেককে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে ২০২৬ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে প্রত্যেকের নামে অন্তত একটি অ্যাকাউন্ট খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুধু যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকবে তেমন নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, এমএফএস কিংবা সমবায় যে কোনো প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য আর্থিক শিক্ষার প্রসার ও সেবা সহজ করতে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল (এনএফআইএস) বাস্তবায়নের জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর আগে গত বছরের মে মাসে কৌশলপত্র মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সার্বিক দিকনির্দেশনার জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে তিন স্তরবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছে। শিগগির এ কমিটি বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে। পরবর্তীতে সময়ে সময়ে কমিটির সামনে বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরা হবে। প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন পরামর্শ দেবে এই কমিটি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রাপ্তবয়স্ক সবার অ্যাকাউন্ট খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে কত শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কের অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বর্তমানে একই ব্যক্তির একাধিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এমনও রয়েছে যে, যার এক বা একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে, তারই আবার এক বা একাধিক এমএফএস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা বা সমবায় প্রতিষ্ঠানে হিসাব রয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল বাস্তবায়নের আওতায় আগামীতে একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই ডাটাবেজে একই ব্যক্তির একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকলে তা শনাক্ত হবে। কেননা যে প্রতিষ্ঠানেই হিসাব থাকুক জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে তা চিহ্নিত করা হবে। এ জন্য প্রতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বীমা, এমএফএস বা সমবায় অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত রিপোর্ট নেওয়া হবে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু ব্যাংক খাতে অ্যাকাউন্ট রয়েছে ১৩ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে আমানত হিসাব ১২ কোটি ৪৯ লাখ। যেখানে জমা রয়েছে ১৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। আর এক কোটি ১৮ লাখ ঋণ হিসাবের বিপরীতে ঋণ রয়েছে ১২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ অনুমোদিত ১৩টি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বা এমএফএস প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট রয়েছে ১১ কোটি ১৫ লাখ। এর বাইরে বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সমবায় প্রতিষ্ঠানের হিসাব রয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশলের মূল লক্ষ্য সবার জন্য মানসম্মত আর্থিক সেবা। কৌশলপত্রের মূল প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাইজেশন এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে টেকসই ও ফলপ্রসূ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথে অভিযাত্রা’। আর এ জন্য এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বছর ২০২৬ সালে সবার জন্য অন্তত একটি অ্যাকাউন্ট বাস্তবায়নের জন্য দূরবর্তী পাহাড়, বিক্ষিপ্ত জনবসতি অঞ্চল বিশেষ করে হাওর, চরের মতো দুর্গম এলাকার মানুষকে সেবার আওতায় আনা হবে। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী, আর্থিক শিক্ষার অভাব থাকা ব্যক্তি, সামাজিক বিচ্যুতি ও অর্থনৈতিক সুযোগে পিছিয়ে থাকা মানুষকে সেবার আওতায় আনা হবে। এ ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট খুলতে অতিরিক্ত নথিপত্রের প্রয়োজনীয়তা কমানো, গ্রাহকের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় আর্থিক পণ্যের অভাব দূর করা হবে।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্টের (ইউএন-সিডিপি) বিবেচনায় সংশ্নিষ্ট সব সূচকে উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে।
কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ঋণ, সঞ্চয়, বীমা, আর্থিক লেনদেন সার্বজনীন ও মানম্মত করা হবে। সবার জন্য আর্থিক পরিষেবা নিশ্চিত করা গেলে টেকসই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিরক্ষরতা ও দুর্নীতিমুক্ত আলোকিত দেশ গঠন করা যাবে। দেশের যুবক, প্রযুক্তি সচেতন জনগোষ্ঠী নতুন ধরনের আর্থিক সেবার ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবর্তিত আর্থিক লেনদেনের বদৌলতে ই-কমার্স, ফিনটেক, ডিজিটাল ক্রেডিটের নতুন সম্ভবনা সৃষ্টি হচ্ছে। ব্লকচেইন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নি, বিগ ডাটা এনালিটিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক খাতের উন্নয়নের ধাপ দ্রুত অর্জন সম্ভব হচ্ছে।