বাংলাদেশের উন্নয়ন কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। কোনো জাদুবলেও আসেনি। এসেছে ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’ অনুভূতি থেকে উঠে আসা সোনার মানুষের হাত ধরে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এ সবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ উন্নয়ন কৌশল ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের ফলে।
রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে রূপকল্প-২০৪১। জাতীয় অর্থনীতিক পরিষদ (এনইসি) সভায় অনুমোদিত হয়েছে ‘রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপায়ণ :বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখ। রূপকল্প-২০৪১ এর ভিত্তিমূলে রয়েছে দুটি প্রধান অভীষ্ট :’১. ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে আজকের মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং যা হবে ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ, ২. বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা।’ ২০৪১ সালের বাংলাদেশে সম্ভাব্য জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি তিন লাখ জন। চরম দরিদ্র লোক, যাদের দৈনিক আয় থাকবে ২.১৬ ডলারের কম এমন লোকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে শতকরা ০.৬৮ ভাগে। আর দরিদ্র লোক, যাদের দৈনিক আয় থাকবে ৩.২০ ডলার, এমন লোকের সংখ্যা হবে ২.৫৯ শতাংশ। ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর ‘উদ্দীপনাময় সূচনা’ হিসেবে ধারণ করা হয়েছে জাতির পিতার আজন্মলালিত স্বপ্ন ‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা’কে।
জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংযুক্ত করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য। নিরাপদ আশ্রয়ণের নির্ভরতা প্রদান করে কর্মসংস্থানে হতদরিদ্র জনঅংশের অভিগম্যতা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই ও মানবিক করার উত্তম চর্চা হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দশটি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’।
বাংলাদেশে আশ্রয়ণ কার্যক্রমের শুরু হয়েছিল জাতির পিতার হাত ধরে। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি পরিদর্শন করেন বর্তমানের লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চড়পোড়াগাছা গ্রাম। সেখানকার ভূমিহীন, গৃহহীন ও অসহায় মানুষকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা প্রদান করেন। পরে ১৯৯৭ সালের ১৯ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিদর্শনে যান ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত কক্সবাজার জেলা। গৃহহীন মানুষের দুর্দশা দেখে কাতর হয় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক হৃদয়। তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের। সেই থেকে শুরু ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে’র পথচলা। প্রথম পর্যায়ে দুই মেয়াদে ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত এক লাখ পাঁচ হাজার ৯১৩টি পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় গৃহীত হয়েছে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প। ১৬ মার্চ ২০২০-এ প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে এক লাখ ৯২ হাজার ৩৩৬টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৪৮ হাজার ৩২৫টি ভূমিহীন পরিবার ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে, ভিক্ষুক পুনর্বাসনসহ ‘নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ কর্মসূচির’ আওতায় এক লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৭টি পরিবারকে তাদের নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য ২৩৪টি টং ঘর ও বিশেষ ডিজাইনের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘গৃহহীনে গৃহদান’ কর্মসূচি রূপ নিয়েছে একটি সামাজিক আন্দোলনে। জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ভূমি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত কর্মযজ্ঞ সমন্বয় করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বিত্তশালীদের স্বেচ্ছা অনুদান, সরকারের সচিবদের অর্থায়নে নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ, করপোরেট অনুদান গ্রহণের মাধ্যমে আশ্রয়ণ তহবিল গঠন ইত্যাদি বহুমাত্রিকতার দরুণ মুজিববর্ষের এই বিশেষ উদ্যোগ ছুঁয়েছে অনন্য উচ্চতা। অসহায়, দরিদ্র, ভিক্ষুক, বিধবা স্বামী পরিত্যক্ত, গৃহহীন ছিন্নমূল যাদের ঘর-জমি কিছুই নাই তাদের দেওয়া হয় সর্বোচ্চ প্রাধিকার, ক শ্রেণি। পরিবারপ্রতি দেওয়া হয় দুই শতক খাস জমি আর টয়লেট, রান্নাঘর, বারান্দাসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট ৩৯৪ বর্গফুটের একটি সেমিপাকা ঘর। বর্তমান ধাপে নির্মাণাধীন প্রতিটি ঘরের ভিত্তিব্যয় ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। দেওয়া হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানা স্বত্বের দলিল/কবুলিয়ত ও নামজারি, বিদ্যুৎ সংযোগ ও নলকূপ।
স্থানভেদে ২ শতক জমির দাম ৩০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা, পরিবারপ্রতি নলকূপ বাবদ সাত হাজার টাকা, নামজারি ও রেজিস্ট্রেশন বাবদ আছে এক হাজার ৭০০ টাকা, বিদ্যুৎ সংযোগ ও ওয়ারিং বাবদ সাত হাজার টাকা, সব মিলিয়ে পরিবারপ্রতি অনুদান প্রায় তিন লাখ ৪৩ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা। প্রধানমন্ত্রী তার ‘গৃহহীনে গৃহদান’ কর্মসূচির মাধ্যমে যার কিছুই ছিল না তাকে করেছেন লাখপতি। ছিন্নমূলকে ক্ষমতায়ন করে বসিয়েছেন সম্মানের আসনে। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে একই বছরের ২০ জুন আরও ৫৩ হাজারের অধিক পরিবারকে জমির স্বত্বসহ গৃহ প্রদান করা হয়। বর্তমানে আরও দুই লাখ গৃহ নির্মাণের কাজ চলমান আছে। জমি ও গৃহ প্রদানের প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ বিশ্বে প্রথম। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে জমি কেনার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়, ঘরসহ জমির মালিকানা বাংলাদেশেই প্রথম।
উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে পর্বতসম সমস্যা থাকলেও তা অলঙ্ঘনীয় নয়। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা ভূমিহীন, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এরূপ প্রয় পৌনে দুই কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করাই হবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সঠিক পরিকল্পনা ও সবার নিবেদিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে উন্নয়নের শিখরে।
ড. মনসুর আলম খান: জেলা প্রশাসক, মেহেরপুর