স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। বিশেষ করে দেশের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধান। ধানের নতুনজাত উদ্ভাবনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) অগ্রগামী। বেসরাকারি বীজ কোম্পানিগুলোর হাইব্রিড জাতগুলোও ভূমিকা রেখেছে। সরকারি-বেসরকারি মিলে এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৩৪১টি ধানের জাত রিলিজ হয়েছে। এর মধ্যে ২০৮টিই হাইব্রিড জাত। যার বেশির ভাগই প্রাইভেট বীজ কোম্পানিগুলোর। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) তিনটি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি ইনব্রিড জাত রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিলিজ হওয়া বা ছাড়কৃত ধানের জাতের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ (বর্তমানে ব্রি) জাত। মূলত এই দু’টি জাতের উদ্ভাবনই পাল্টে দিয়েছে দেশের কৃষি তথা ধান উৎপাদনের চেহারা। মেগাভ্যারাইটি হিসেবে এখন পর্যন্ত ব্রি উদ্ভাবিত এই দু’টি জাতের ধারে কাছেও যেতে পারেনি অন্যকোনো জাত। অতীতে বেশ কিছু জাত মেগাভ্যারাইটি হিসেবে কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হলেও নানা কারণে তা ঝরে পড়ে যায়। তবে বেশির ভাগ জাতই কাক্সিক্ষত সাফল্য তথা মেগাভ্যারাইটি হতে পারেনি। বলা চলে জনপ্রিয় হওয়ার আগেই মাঠে মারা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে দেশে যেখানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২১ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টন। ফলে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১১ দেশের একটি বাংলাদেশ। প্রতি বছর দেশের এক শতাংশ হারে জমি কমলেও কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে গাণিতিক হারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় চার কোটি ৫৫ লাখ টন। এর মধ্যে বোরো চালই উৎপাদিত হয়েছে দুই কোটি টনের বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সবমিলিয়ে এই বছর মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে তিন কোটি ৮৬ লাখ টন।
সবচেয়ে বেশি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। এখন পর্যন্ত মোট ১০৬টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত রিলিজ হয়েছে তাদের। এর মধ্যে ৯৯টি ইনব্রিড এবং ৭টি হাইব্রিড।
এ বিষয়ে ব্রির পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, এর বাইরে দু’টি ইনব্রিড ও একটি হাইব্রিড জাত ছাড়করণের অপেক্ষায় আছে। তিনি জানান, ব্রির জনপ্রিয় জাতগুলোর মধ্যে আমন ধানজাত বিআর ১১, ৪৯, ৭৫ ও ৮৭ মেগাভ্যারাইটি। বোরো জাতের মধ্যে বিআর ২৮, ২৯, ৫৮, ৮৮ ও ৮৯ মেগাভারাইটি। এ ছাড়া সম্প্রতি রিলিজ হওয়া বঙ্গবন্ধু ধান ১০০ জাতটিও মেগাভ্যারাইটি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ব্রির এই বিজ্ঞানী বলেন, জাত একেবারে বিলুপ্ত হয় না। রিলিজ হওয়া সব জাতই আছে। হয়তো এখন চাষাবাদ কমে গেছে। যেমন বিপ্লব ধান, এটা বিপ্লবের মতোই ছিল। এ রকম অনেক জাতই আস্তে আস্তে উৎপাদন ও চাষাবাদ কমেছে। নতুন জাতগুলোও ভালো হবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, দেশে ধানের ভ্যারাইটি সংখ্যা বাড়ছে। তাই নতুন যেগুলো আসছে আগের মতো একচেটিয়া মেগাভ্যারাইটিজ হবে না।
জানা যায়, ১৯৭৩ সালে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রথম ধানের জাত ছিল ‘বিপ্লব’। কৃষকেরা এই জাত পেয়ে আশান্বিত হয়েছিলেন। তবে পোকার আক্রমণ ও বৈরী প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় ‘বিপ্লব’ জনপ্রিয় হয়নি। আশির দশকের শুরুতে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে প্রথম জনপ্রিয় হয় ‘মুক্তা’ নামের একটি জাত; যাকে বিজ্ঞানীরা বিআর-১১ নাম দিয়েছিলেন। এরপর বিজ্ঞানীরা একের পর এক জাত উদ্ভাবন করে গেলেও কোনোটিই জনপ্রিয় হচ্ছিল না। বৃষ্টিনির্ভর এসব জাত দিয়ে সব মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করা যাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ব্রির বিজ্ঞানীরা ১৯৯৪ সালে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ নামে দু’টি জাত উদ্ভাবন করেন। এরপর মূলত দেশের কৃষির দৃশ্যপটই পাল্টে যায়। বৃষ্টিহীন বোরো মৌসুমের সেচনির্ভর এই জাত খুব কম সময়ের মধ্যেই সারা দেশের কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখনো কৃষকের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই দু’টি জাত। ২০২১ সালে এসে শততম জাত হিসেবে যুক্ত হয়েছে ব্রি’ উদ্ভাবিত জিঙ্কযুক্ত নতুন জাত বঙ্গবন্ধু। এই নতুন জাতটিও মেগাভ্যারাইটি হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মোট ২৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে (রিলিজ)। রিলিজের অপেক্ষায় রয়েছে বিনা ধান ২৫। বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত বিনার ২৪টি জাত ছাড়করণ হয়েছে। ছাড়করণের অপেক্ষায় রয়েছে বিনা ধান ২৫। ছাড়কৃত ধানগুলোর মধ্যে মেগাভ্যারাইটি হিসেবে মাঠে রয়েছে (আমন) বিনা-১১, ১৬ ও ১৭। তবে সবচেয়ে ভালো করছে বিনা ১৭। আর বোরোতে ভালো করছে বিনা ১০, ১৪ ও ২৪। বিনা ধান ২৫ হলো চিকন দানার। বোরো মওসুমের এই ধানের জাতটির জীবনকাল ১৪৫ দিন।
এ প্রসঙ্গে ব্রির মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীর গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। এরপর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। স্বাধীনতার পর যেখানে আমরা ৭ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারতাম না, সেখানে আমরা ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর পরও খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকছে। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের ডাক এবং তার নির্দেশনা।
ড. মো: শাহজাহান কবীর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য আমরা লবণাক্ততা, বন্যা ও খড়াসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। তাপ ও ঠাণ্ডাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। ইতোমধ্যে আমরা অনেক প্রিমিয়াম কোয়ালিটি চালের জাত উদ্ভাবন করেছি। আমরা চাইছি, গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক ও ভিটামিন ‘এ’-এর জোগান চালের মাধ্যমে দিতে। যাতে এসব খনিজ উপকরণের ৫০ থেকে ৮০ ভাগের জোগান চাল থেকে পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে আমরা এসব জাত উদ্ভাবন করেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড তিন কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। উচ্চফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানী জমি। দেশে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি ভূমিকা রয়েছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোরও।